গত ১৩ মে’র সংবাদপত্রগুলোয় ছিল এক মর্মান্তিক শিরোনাম। শিরোনামটি হলো ‘শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে ৪৫ মিনিট আটকে থেকে রোগীর মৃত্যু’। গাজীপুরের শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডেকেল কলেজ হাসপাতালের লিফটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকার পর এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। রোগী মমতাজ বেগম (৫৩) গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার রানীগঞ্জ বাড়িগাঁও গ্রামের সারফুদ্দিনের স্ত্রী।
মমতাজের মেয়ে শারমিন আক্তার বলেন, ‘আমার মা সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে সকাল ৬টায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। প্রথমে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। সেখানে পরীক্ষার পর জানা যায়, হার্টের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরে হাসপাতালের ১১ তালা থেকে ৪ তলার হৃদরোগ বিভাগে নেওয়ার কথা বলা হয়। লিফটে উঠলে ৯ তলার মাঝামাঝি এসে হঠাৎ লিফটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় আমি, আমার মামা, ভাইসহ কয়েকজন মাকে নিয়ে ভেতরে ছিলাম। আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমরা লিফটে থাকা তিনজন লিফটম্যানের নম্বরে কল দিই। তারা গাফিলতি করেন। ফোনে আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন।’
শারমিন আক্তারের দাবি, ‘৪৫ মিনিট আমাদের লিফটে আটকে থাকতে হয়েছে। উপায় না পেয়ে ৯৯৯-এ কল দেই। ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে আমাদের উদ্ধার করেন। লিফটম্যানদের গাফিলতির কারণে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো দায়িত্ববোধ নেই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মমতাজ বেগমের মেয়ে শারমিন আক্তার অনেক মোলায়েম ভাষায় তাদের ট্র্যাজেডির কথা জানিয়েছেন। আসলে লিফটম্যানরা নিছক দায়িত্ববোধহীনতার পরিচয় দেননি। তারা বস্তুত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা একজন রোগীকে হত্যা করেছেন। কর্তব্যে অবহেলা নয়, তাদের বিচার হওয়া উচিত খুন করার অপরাধে। বস্তুত তারা হৃদয়হীন খুনি ছাড়া আর কিছু নন। তাদের কাছে ফোনে সাহায্য চাওয়ায় তারা খারাপ ব্যবহার করেন। হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে যারা দায়িত্ব পালন করেন অথবা কাজ করেন, তাদের থাকা উচিত সর্বোচ্চ মানবিক গুণাবলী। মানবিক গুণাবলি তো দূরের কথা, এ লিফটম্যানরা পশুসুলভ আচরণ করেছে। তারা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের জন্য বিভাগীয় শাস্তি যথেষ্ট নয়। দায়িত্বে অবহেলা করে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে তারা খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন।
শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম লিফটের ভেতরে রোগী মমতাজ বেগমের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ধরনের তদন্ত কমিটি সম্পর্কে আমরা সংবাদপত্রে অনেক সংবাদ ছাপা হতে দেখেছি। রেল, লঞ্চ, সড়ক দুর্ঘটনার পর এবং অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে অতীতে অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। এসব তদন্ত কমিটি তদন্ত করে কী পেল, কে বা কারা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তা কদাচিৎ জানা যায়। এসব ব্যাপারে প্রয়োজন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা। গোটা তদন্ত প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ হয় এবং মানুষ জানতে পারে কী হয়েছিল, কারা দায়ী, তাহলে এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনা অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব হতো। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হতে পারে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছে, লিফটে আটকে পড়া রোগীসহ লোকজন দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটের দরজার নিরাপত্তাব্যবস্থা কাজ করেনি। এ ব্যাখ্যা আমলযোগ্য কিনা, আশা করি তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।