বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে আবাসযোগ্য করার জন্য মঙ্গল গ্রহকে বেছে নিয়েছেন। এ জন্য হাজার বছরের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। মানব অস্তিত্ব রক্ষায় গ্রহান্তরে বসতি স্থাপন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু মঙ্গলে যদি সত্যিই অণুজীবের উদ্ভব ঘটে থাকে, তাহলে কি এই কৃত্রিম আবাসনের কাজটি করা উচিত হবে? প্রশ্নটি কিছুদিন আগে আমার এক বক্তৃতায় কিশোর-তরুণদের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলাম। কিছুটা দোলাচলের মধ্যে কয়েকজনই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘না।’ তাদের উত্তর শুনে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু নিজের নয়, অন্যের স্বাধীন বিকাশ ও অস্তিত্ব রক্ষায় সমান গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা ভাবছে। এতে ভিন্ন ভিন্ন সমাজের স্বাধীন বিকাশে মানুষ সহনশীল হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে তা মনে হয় না। আমরা একটা কালচারাল ব্যাটেল ফিল্ড বা সাংস্কৃতিক যুদ্ধে প্রবেশ করছি।
অথচ বিজ্ঞান আমাদের জন্য অসাধারণ একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, নমনীয়তা এনে দিয়েছে। মনোজগতে তার প্রভাব ফেলছে। কিন্তু সমাজে তা আত্তীকরণ হচ্ছে না। এর কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে রাজনীতি ও বিজ্ঞানের মধ্যকার বিভাজন হচ্ছে অন্যতম। রাজনীতিকেরা বিজ্ঞানকে দেখেছেন ক্ষমতা লাভের উপায় হিসেবে। ফলে রাজনীতি ও বিজ্ঞানের মধ্যে তেমন যোগাযোগ গড়ে উঠছে না। যোগাযোগটা পর্যাপ্ত না হওয়ায় বিজ্ঞানীরা রাজনীতির কূটচক্রে জড়িয়ে গিয়ে কথা বলেন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে নয়। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সমাজ-সভ্যতার সমন্বয় ঘটেনি। মানুষও বিজ্ঞান বোধ ধারণ করতে পারেনি। এ কারণে প্রযুক্তির বিকাশে যে বিশ্বায়ন দেখা দিয়েছে, তাতে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক সংকট মোকাবিলায় আমরা তাল মেলাতে পারছি না। প্রযুক্তির মোড়কে বিজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোগের বস্তু।
বর্তমানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানবসমাজ এখন অনেকটা একীভূত। অন্তত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জোরে পৃথিবী নামের গ্রহে আমাদের বসবাস আগের চেয়ে স্পষ্ট। তবে এই স্পষ্টতা আমাদের বৈচিত্র্য, বহুমত আর বহু সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে আগে আমরা প্রত্যেকে নিজেদের সঠিক ও শ্রেষ্ঠ ভাবতাম, সেখানে আরেক পরিবেশে, আরেক ভৌগোলিক অবস্থানের মানুষের জীবনযাপনের রীতি ও পোশাক-আশাকের ভিন্নতা দেখে এতটাই হতভম্ব হয়েছি, মেনে নিতে পারছি না। আবার আধুনিক প্রযুক্তি ও পুরোনো ধারণা নিয়ে জীবনযাপনও একধরনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর জন্য যে প্রস্তুতি ও সময় প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। বাণিজ্যের লোভে অনিয়ন্ত্রিত প্রাযুক্তিক বিকাশে প্রযুক্তিকে ব্যবহার না করে প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়েছি, প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। মাত্র ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এটি ঘটেছে। ফলে মানবিক বোধ বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরমতকে সহ্য করে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা তৈরি হয়নি। মানুষ তার আদিম প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়েই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল তৈরি করেছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে একটি কবিতার কথা মনে আসছে: ‘সঙ্গী হবে বলে নৌকা ভিড়িয়েছিলাম ঘাটে/ কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে কানামাছির হাটে’ (কানামাছি, আরিফ বুলবুল, ২০১৭)। এ রকম পরিস্থিতিতে পুরো সভ্যতা কানামাছির হাটে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। না-হলে একই পৃথিবীতে বাস করেও বিশালসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়ে কেমন করে? যারা এই গ্রহের বাসিন্দা, তাদের কীভাবে বলা হয় তোমার কোনো দেশ নেই? এ রকম পরিবেশ তখনই তৈরি হয়, যখন গণতান্ত্রিক চর্চা ও সহনশীলতার বিকাশে বিঘ্ন ঘটে।
আমি আমার অনেক লেখায় বলার চেষ্টা করেছি, কত সহজে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতে পারি। যেমন গবেষকেরা মধ্যযুগব্যাপী গামা রশ্মি বিস্ফোরণের তীব্র আঁচের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন, এটা সুদূর মহাশূন্যে কোনো বিস্ফোরণ থেকে ঘটেছে। হাজার বছর না হয়ে নাকি শত আলোকবর্ষে হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত; অষ্টম শতাব্দীতে এর একটি ঘটনা আমাদের মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে দিত!