আমাদের দেশে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার সংবাদকর্মীদের ‘কণ্ঠরোধ’ নিয়ে যতটা উতলা ভাব পশ্চিমা কিংবা আমাদের দেশের কারও কারও মধ্যে দেখা যায়, তার সিকি ভাগও সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা, চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি ব্যাপারে দেখা যায় না। যেন সাংবাদিকদের কাজ হলো ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে সবার ‘অধিকার ও স্বাধীনতা’ পাহারা দেওয়া, নিজেদের খাওয়া-পরার বিষয়টি তাদের জন্য জরুরি নয়।
পশ্চিমা দেশগুলোয় গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব অবস্থায়, সব ক্ষেত্রে অবাধ কি না, আমি জানি না। ওই সব দেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমার কাছে সেটা অনেকটা ‘না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ’র মতো। তবে স্পনসরড সাংবাদিকতা যে ওই সব দেশেও আছে, তা কি মাঝে মাঝে শোনা যায় না? ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় ‘এমবেডেড সাংবাদিকতা’র কথা কি আমরা শুনিনি? তখন সামরিক বাহিনীর ছাড় করা সংবাদই মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যারা দুনিয়াজুড়ে রাজনৈতিক আধিপত্য জারি রাখতে চায়, তারা সব সময় ‘বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রচার’ করতে সবাইকে সমানভাবে উৎসাহিত করে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। যে খবর তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, সেই খবর ‘কিল’ করার ভূরি ভূরি নজির আছে। আবার ভুয়া খবর পরিবেশন করে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়ার নিন্দনীয় উদাহরণও আমাদের সামনে আছে।
আমরা যে অনেক সময় নানা বিষয়ে পশ্চিমের দৃষ্টান্ত দিই, এটাও আমার কাছে খুব ভালো লাগে না। পশ্চিমের সমাজ, রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চর্চা—কোনোটাই আমাদের মতো নয়। তবে হ্যাঁ, ভালো জিনিস গ্রহণের মতো উদারতা অবশ্যই থাকা উচিত।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রই এখনো ভঙ্গুরতা কাটিয়ে শক্ত ভিত গাঁথতে পারেনি। আমাদের দেশে যাঁরা উদার গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাঁরাও সর্বতোভাবে সামন্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিকভাবে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক দলের মধ্যে যাঁরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বরদাশত করেন না, তাঁরাই আবার গণমাধ্যমের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হা-হুতাশ করেন।
অনেকে হয়তো অখুশি হবেন, তারপরও আমি এটা মনে করি যে বাংলাদেশে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার পরিবেশ এখন নেই। খুব শিগগির সেটা হবে বলেও আমি মনে করি না। গণমাধ্যমের মালিকানা এবং পরিচালনা যাঁদের হাতে, তাঁরা কেউ নিজেদের স্বার্থের পরিমণ্ডলের বাইরে হাঁটতে চান না, চাইবেন না।
আমি অবশ্য আজকের আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই সাংবাদিকদের বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তার ওপর। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে বলার মতো কথা অনেক আছে। তবে সংক্ষেপে এটাই বলা যায় যে দেশে কর্মরত সাংবাদিকদের অধিকাংশ এখন নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত। তাঁদের বেশির ভাগের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। চাকরি চলে গেলে তাঁদের শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত বেতন দেওয়া হয় না। সৎ সাংবাদিকতার পথে সরকার যত না অন্তরায় সৃষ্টি করে, তার চেয়ে বেশি বাধা তৈরি করেন কোনো কোনো মালিক। এটা নিয়ে কেউ বিতর্ক করতে পারেন; কিন্তু তাতে বাস্তব অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে না। সাংবাদিকদের যতক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকার মতো সম্মানজনক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যম মানসম্পন্ন হবে না। সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার দেখাও পাওয়া যাবে না।
শত ফুল ফুটতে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে দেশে অসংখ্য সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়েছে। তবে এগুলোর কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো এখন নানা ব্যাধিতে ধুঁকছে। খামখেয়ালিপনার কারণে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত মান অর্জনের সক্ষমতা রয়েছে অধরা। ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু অল্প পথ চলার পরই শুরু হয় আর্থিক সংকট। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলে মালিকের উৎসাহে ভাটা পড়ে। এই সংকট কাটানোর উপায় নিয়ে কারও কোনো গভীর চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আর্থিক সংকট দূর না হলে কীভাবে এগুলো চলবে?