একটি দেশের সফলতার প্রধান মাপকাঠি হলো 'সে দেশের মানুষ কতটা ভালো আছে'। এর একটি পরিমাপক জাতিসংঘের 'ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স ২০২৪' অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানেরও নিচে।
মানুষ হিসেবে আমরা কতটা স্বাধীন তার একটি সূচক আটলান্টিক কাউন্সিলের 'ফ্রিডম অ্যান্ড প্রসপারিটি ইনডেক্স'। ২০২৪ সালের রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান আফগানিস্তান ছাড়া বাকি সব দেশের নিচে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তুলনামূলক ভালো, যদিও স্ট্যাটাস এখনো 'বেশির ভাগই অসচ্ছল' অবস্থায় রয়ে গেছে।
বিগত কয়েক দশকে স্বাধীনতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমান্বয়ে নিচে নেমেছে, কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতায় এগিয়েছে। এই বৈপরীত্য অনেককে অবাক করলেও এর অন্তর্নিহিত কারণটি সহজ। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার এবং তারা এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পিছনে রয়েছেন রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এবং তারা সফল হয়েছেন।
প্রবাসীরা নিয়মিত-অনিয়মিত উপায়ে দেশে ৪৫ বিলিয়ন ডলার পাঠান। টাকার মাল্টিপ্লায়ার অ্যাফেক্টে তা ১৩৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রূপান্তরিত হয়, যা জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। এ অর্থই গ্রামাঞ্চলে আধুনিক কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, ব্যবসা ও সেবাখাতের প্রয়োজনীয় পুঁজির যোগান দিয়ে সচ্ছলতা এনেছে। গার্মেন্টস শ্রমিক, রেমিট্যান্স প্রেরণকারী এবং কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমই বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নের মূল কারণ। তা না হলে আমরা এখনো 'তলাবিহীন ঝুড়ি'ই থেকে যেতাম।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, উর্বর মাটি, মিষ্টি পানি, পর্যাপ্ত সূর্যলোক ও বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলের মতো অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশ। ভাষা ও সংস্কৃতিতে প্রায় বৈষম্যহীন একটি জাতি। কেবলমাত্র সুশাসন নিশ্চিত করা গেলেই দেশটি হতে পারত পৃথিবীর অন্যতম সুখী, মুক্ত ও সমৃদ্ধশীল একটি রাষ্ট্র। কিন্তু সর্বস্তরের দুর্নীতি এবং সুশাসন ও ব্যবসাবান্ধবতার অভাব এতটাই প্রকট যে একজন সাধারণ মানুষও মনে করেন, রাষ্ট্র উন্নয়নের সহায়ক নয়, বরং বাধা।
রাষ্ট্র যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে তার জন্য মূলত দায়ী সমাজের নেতৃত্ব—রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আমলা, পেশাজীবী, গণমাধ্যম ও ব্যবসায়ী শ্রেণি। সাধারণ মানুষ সহজ ও সরল প্রকৃতির। তাই দেশের দুরবস্থার জন্য তারা মোটেও দায়ী নয়—এমন একটি ধারণা সমাজে রয়েছে। তবে একটি কথা প্রচলিত আছে, যার মর্মার্থ হলো, 'যে দেশের জনগণ যেমন, রাষ্ট্র ঠিক তেমনই হয়ে থাকে।' দেশের সম্পদ লুটের জন্য একজন দুর্বৃত্ত নেতা যেমন দায়ী, অজ্ঞতাবশত অথবা সামান্য টাকার লোভে ওই মানুষটিকে যে ভোট দিয়েছে সেও দায়ী।
রাজনৈতিক দার্শনিক হান্না আরেন্ডটের মতে রাজনীতির অন্যতম প্রধান কাজ মানুষকে সক্রিয় নাগরিকে রূপান্তর করা। তাদের রাজনীতি সচেতন এবং নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করা। একজন দুর্বৃত্তও যখন সমাজ সচেতন হয়ে উঠে, তখন সে বুঝতে পারে যে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমাজের স্বার্থ রক্ষাই দীর্ঘ মেয়াদে তার ও তার সন্তানদের অধিক লাভবান করবে। তখন সে-ও সমাজের পক্ষে কাজ করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল দায়িত্বই হলো জনগণের মাঝে সেরকম চিন্তার বিকাশ ঘটানো।
ঔপনিবেশিক ভারতে জমিদার নামক একটি দালাল শ্রেণি ও প্রভুসুলভ আমলাতন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে। ১৮৬১ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের গোড়াপত্তন হয়, যার পুরোধায় ছিল জমিদার, ব্যবসায়িক ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি। শোষণমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামো, আইন ও প্রশাসন যন্ত্র যেহেতু ওই শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য ছিল অত্যন্ত উপযোগী, তাই তারা স্বাধীনতার পরও এর পরিবর্তন করেনি।
পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময় বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রতিটি সরকার একই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে। দক্ষিণ এশিয়ার পশ্চাৎপদতার এটিই প্রধান কারণ।