একটু আগেই বা কিছুদিন আগে হয়তো সব ঠিক ছিল। ডাক্তারি সব রিপোর্ট, গর্ভস্থ সন্তানের পজিশন, মায়ের অবস্থা—সবই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য উপযোগী। কিন্তু হঠাৎই জানা গেল, গর্ভস্থ সন্তানের মাথা বড় হয়ে যাচ্ছে, পানি ভেঙে যাচ্ছে, শিশুর গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে গেছে, শিশু পেটের ভেতরেই ময়লা খেয়ে ফেলেছে। ফলে এর মধ্য়েই সিজার না করালে বিপদ ঘটার আশঙ্কা আছে। এমন সংবেদনশীল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয়বার ক্রস চেক করাবেন? সে সময় হাতে আছে? নাকি অনাগত সন্তান ও গর্ভবতী মায়ের নিরাপদ জীবনের কথা ভেবে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই অপারেশনের টেবিলে তুলবেন?
অনেক সময় দেখা যায়, স্বাভাবিক প্রসবের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় প্রসববেদনা উঠেছে, পরে ব্যথা আবার নেমে যাচ্ছে; আবার দেখা গেল গর্ভস্থ শিশু উল্টে গেছে বা ওপরে উঠে আছে; নিচে নামছে না। তখনো হয়তো সার্জারির সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তৎক্ষণাৎ। কারণ অনেক মা-ই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য সাহস রাখলেও, শেষ মুহূর্তে চিকিৎসক যখন জানান গর্ভস্থ সন্তানের অবস্থান স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ঠিক নেই, তখন আর এদিক-ওদিক কিছুই ভাবার উপায় থাকে না। হবু মা ও পরিবারের সবাই প্রত্যাশা করেন যাতে অনাগত শিশু ও মা নিরাপদ থাকেন।
পরিবার, পরিজন, বন্ধুমহলে যখন নতুন অতিথি আগমনের খবর পাওয়া যায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে এমন খবরও জানা যায় যে শিশুটিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্য়মেই পৃথিবীর মুখ দেখাতে হয়েছে। কারণ? ওই একই—হয় নাড়ি পেঁচিয়ে গিয়েছিল, পানি ভেঙে গিয়েছিল, উল্টে গিয়েছিল বা আরও অনেক কিছু। কিন্তু ইদানীং এমন বিষয় জানার পর নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে, আধা হাত সমান দৈর্ঘ্যের নতুন মানবদের বলতে ইচ্ছে হয়, ‘কেন রে? মায়ের পেটের ভেতর এমন কী করে করে বেড়াস যে তোদের প্রায় সবারই নাড়ি পেঁচিয়ে যায়, উল্টে যাস; আর সোজা হতে পারিস না! কাটাছেঁড়া করে তবেই তোদের পৃথিবীর মুখ দেখা হয়!’ প্রশ্ন জাগে, ইদানীং সব নারীরই কি ‘কমপ্লিকেটেড প্রেগন্যান্সি’ থাকে? কোনো নারীই কি শারীরিকভাবে ফিট নন?
আশপাশে একটু চোখ রাখলেই ঠাহর হবে, বর্তমানে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রসব কী হারে কমেছে। উল্টোদিকে ব্যাপক হারে বাড়ছে সি-সেকশন ডেলিভারি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্মের হার ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে অস্ত্রোপচারে শিশুজন্মের হার ছিল ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ; অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে সি-সেকশন ডেলিভারির মাধ্য়মে শিশুর জন্ম বেড়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০১০-এ এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০ বছরে এই হার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৭১ শতাংশ!
কেন বাড়ছে সি-সেকশন ডেলিভারি? কতটা প্রয়োজনে, কতটা অপ্রয়োজনে? প্রয়োজন ব্যতীত সি-সেকশন ডেলিভারি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য়ের জন্য কতটা উপযোগী, সেটাও একটা প্রশ্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, যেসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবে মা বা শিশুর বা উভয়ের জীবনের ঝুঁকি থাকে, শুধু সেসব ক্ষেত্রেই মূলত অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার আবশ্যক হতে পারে, এর বাইরে নয়।
আর আমাদের এখানে কী হচ্ছে? এ যুগে সি-সেকশন ডেলিভারি ছাড়া সন্তান জন্মদান যেন মিথ হয়ে উঠছে। তার ওপর একবার সি-সেকশন ডেলিভারি হলে পরবর্তী সন্তানদের জন্মও হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়।
যদি খরচের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায়, সি-সেকশন ডেলিভারিতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকভেদে একটা বড় অঙ্ক খরচ হয়, যা স্বাভাবিক প্রসবের খরচের তুলনায় অনেকাংশে বেশি। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক কেবল নির্দিষ্ট কিছু ক্লিনিক ও হাসপাতালে সি-সেকশন ডেলিভারিই করে থাকেন। ফলে তিনি চিকিৎসক হিসেবে ভালো হলেও যাঁরা প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছেন এবং স্বাভাবিক প্রসবের কথা ভাবছেন, তাঁদের অন্য বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। বলা ভালো, শরীর ও সন্তান ধারণের ইচ্ছে নিজের হলেও, শারীরিক অবস্থা আসলেই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রস্তুত কি না, সেটা জানার অবস্থাও যেন এখানে নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই সি-সেকশনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।