কয়েক দশক আগেও গ্রামীণ বনবাদাড়ে ছিল বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ। এমনও দেখা গেছে, দিনদুপুরে হিংস্র প্রাণীরা গেরস্তবাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়াত। হাঁস-মুরগি শিকারের লোভে গ্রামীণ বনঝোপে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে দেখা যেত যখন-তখন। ঝোপের কাছ ঘেঁষে লোকজন একাকী যাতায়াত করারও সাহস পেত না। বড়রা সঙ্গীসাথি বা লাঠিসোঁটা নিয়ে জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে চলাফেরা করলেও ছোটদের বিষয়টা ছিল ভিন্ন—ভয়ে জঙ্গলের ধারেকাছেও যেত না; বিশেষ করে ছোটরা সন্ধ্যা লগ্নে একাকী ঘরের বাইরে বের হতো না।
আসলে তখন শিয়াল কিংবা বাগডাশার চিৎকারে ছোট-বড় সবারই কলজে কেঁপে উঠত। সেই সময়টা এখন আর নেই। গ্রামীণ বনবাদাড়ে বন্য প্রাণী নজরে পড়া তো দূরের কথা, বর্তমানে হাঁকডাকও তেমন একটা শোনা যায় না। একেবারে অজপাড়াগাঁ অথবা পাহাড়ি অঞ্চলে যৎসামান্য এদের বিচরণ রয়েছে যদিও, কিন্তু ওরাও এখন আর ভালো নেই; খাদ্য-বাসস্থানসংকটের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে।
বন্য প্রাণীরা শুধু যে খাদ্য-বাসস্থানের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। নানাবিধ কারণেই দেশ থেকে বন্য প্রাণীরা হারিয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে: ১. বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেওয়া, ২. অবাধে বৃক্ষনিধন (বিশেষ করে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে যেসব পাখি বাসা বাঁধে, তাদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপক), ৩. খাদ্যসংকট, ৪. জলাশয় ভরাট, ৫. পাখিদের বিচরণক্ষেত্র হাওর-বাঁওড়সহ অন্যান্য জলাশয়ে অতিরিক্ত মাছ শিকার, ৬. চরাঞ্চলে জেলেদের উৎপাতের ফলে মৎস্যভুক পাখিরা বিপাকে পড়ছে, ৭. বন্য প্রাণী শিকার ও পাচারের ফলে আশঙ্কাজনক হারে এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া কবিরাজেরা গ্রামীণ হাট-বাজারে বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির মাংস বিক্রি করার ফলে বন্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে; বিশেষ করে ধনেশ পাখি, বনরুই কিংবা শিয়ালের মাংস কেটে সামনে রেখে বাত-ব্যথার ওষুধ বলে তাঁরা চালিয়ে দিচ্ছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক বছর আগে প্রথমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘তক্ষক বা টুট্টেং’ শিকার শুরু হয়েছিল। পরে দেশের সর্বত্রই ‘তক্ষক’ শিকারির সংখ্যা বেড়ে যায়। রীতিমতো বেকার যুবকদের এই নিরীহ সরীসৃপ ধরতে হন্যে হয়ে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। অথচ তারা আজও জানে না যে এটা কী কাজে আসে অথবা এটা কোথায় বেচাকেনা হয় বা আদৌ বেচাকেনা করা যায় কি না। শুধু একটা গুজবের কারণে দেশের অসংখ্য ‘তক্ষক’ প্রাণ হারিয়েছে। যুবকেরা ‘তক্ষক’ শিকার করে সুতা দিয়ে বেঁধে রেখেছে অথবা কৌটায় ভরে রেখেছে বিক্রির উদ্দেশ্যে। অথচ উল্লেখযোগ্য কোনো ক্রেতার খোঁজ পায়নি। ফলে যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে। সুতায় পা কেটে অথবা কৌটায় দম বন্ধ হয়ে প্রাণীগুলো মারা গেছে। অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সে বছর; যা সত্যিই একটি দুঃখজনক বিষয় ছিল এই প্রাণীগুলোর জন্য। সেই ধারাবাহিকতায় আজও তক্ষক শিকার করছে যুবকেরা।
এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বন্য প্রাণীর বেশ কিছু প্রজাতি দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। কিছু প্রজাতি রয়েছে বিপন্নের পথে। আবার কিছু প্রজাতি রয়েছে মহাবিপন্নের পথে। যেমন হারিয়ে গেছে ফ্লোরিকান ময়ূর, পিংকমাথা হাঁস ও রাজশকুন। আর হারিয়ে যেতে বসেছে ভাদিহাঁস, বালিহাঁস, দিগহাঁস, কালো তিতির, চন্দনা, বাংলা শকুনসহ নানা প্রজাতির পাখি। এ ছাড়া আরও ১৯ প্রজাতির পাখি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
উল্লেখ্য, যেকোনো ধরনের প্রাণীর প্রজাতি যদি প্রকৃতি থেকে বছর দশেকের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ বা এরও অধিক বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সাধারণত সেই প্রজাতি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান পায়।
প্রাণীদের মধ্যে মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ‘লজ্জাবতী বানর’। আমাদের দেশে বেশ কিছু প্রজাতির প্রাণী আজ মহাবিপন্নের তালিকার রয়েছে। এর মধ্যে লজ্জাবতী বানর অন্যতম। প্রাণী বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এটি দ্রুত হারিয়ে যাবে এ দেশ থেকে। ফলে লজ্জাবতী বানর ‘রেড সিগন্যাল’-এর আওতায় রয়েছে। এর অন্যতম কারণ অবাধে বনভূমি উজাড়। আগেও বলেছি, লজ্জাবতী বানরের বাসযোগ্য স্থান হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লাউয়াছড়ার গভীর জঙ্গলে। উঁচু গাছের মগডালে থাকতে এরা পছন্দ করে। জনমানবের পদচিহ্ন নেই যেখানে, সেখানেই ওদের বাস। অন্য কারণটি হচ্ছে, এদের প্রজনন হারও সন্তোষজনক নয়। বছরে মাত্র একটি বাচ্চা প্রসব করে মাদি বানর। আবার গড় আয়ুও সন্তোষজনক নয়। মাত্র ১০-১২ বছর বাঁচে, তা-ও যদি অনুকূল পরিবেশ পায়।