ধরা যাক, যুদ্ধক্ষেত্রে কামান-বন্দুক সবই আপনার আছে। কিন্তু গোলা-গুলি নেই। ফল কী হবে তা সবাই বোঝে। জ্বালানি হচ্ছে ওই গোলা-গুলির মতো। আপনার যথেষ্ট সংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। শিল্প, কলকারখানা আছে। মেট্রোরেল আছে। এসবই আরও করছেন। কিন্তু আপনার জ্বালানি নেই। তাহলে এর কোনোটিই চলবে না।
আবার চিত্রটি যদি বিপরীত হয়? অর্থাৎ আপনার প্রচুর জ্বালানি আছে। আর কোনো কিছু প্রয়োজনমতো নেই। তাহলে কী হবে? তাহলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে বিনিয়োগ করার জন্য। এই ত্রিপক্ষীয় বিনিয়োগে সবকিছুই দ্রুত হয়ে যাবে।
এই উপলব্ধি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার। জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে তাঁর এই উপলব্ধি। এর আগে এই পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার এমন উপলব্ধির কথা কখনো শুনিনি। হয়তো কারও কারও মধ্যে ছিল। কিন্তু প্রকাশ করেননি। তিনি প্রকাশ করছেন এবং জ্বালানি খাতের ভিত শক্তিশালী করার জন্য সক্রিয় আছেন।
ইদানীং সরকারের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জ্বালানি খাতের উন্নয়ন নিয়ে, বিশেষ করে দেশীয় জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছেন। কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তাঁদের অন্যতম। একটানা প্রায় ১৫ বছর ধরে তাঁরাই এ খাতের উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেখানে দেশীয় জ্বালানি সম্পদের উন্নয়নের বিষয়টি ছিল একপ্রকার উপেক্ষিত।
এখন বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েন, যুদ্ধবিগ্রহ এবং সেই কারণে জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার চাপে পিষ্ট হয়ে দেশীয় জ্বালানি সম্পদের আহরণ বাড়ানোর প্রতি নজর পড়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসার প্রায় এক দশক পরে এবার দেশের সমুদ্র অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নতুন উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
দেশের স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর জন্যও নতুন করে পিএসসি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এর বাইরে দেশের বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো এবং চিহ্নিত এলাকায় নতুন কূপ খনন করে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো, দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ, পরিত্যক্ত কূপগুলো থেকে পুনরায় গ্যাস উত্তোলন প্রভৃতি কাজ শুরু করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে দেশের জ্বালানি খাতের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমরা দৃষ্টিপাত করতে পারি।
নতুন কূপ খনন: এ বিষয়ে ২০২২-২৩ সালে গৃহীত যে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কাজ চলমান রয়েছে তা হলো, নতুন এবং ওয়ার্কওভার (পুরোনো কূপের সংস্কার) মিলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এর মাধ্যমে দৈনিক মোট ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১১টি কূপ খনন সম্পন্ন হয়েছে। তাতে দৈনিক মোট ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে; যার মধ্যে ৩৩ মিলিয়ন জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন শুরু হয়েছে। আরও ৩টি কূপ খননের কাজ চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না যে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
আরও বড় পরিকল্পনা: ইতিমধ্যে কূপ খননের আরও বড় একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ৬৯টি নতুন কূপ খনন এবং ৩১টি কূপে ওয়ার্কওভার (সর্বমোট ১০০টি কূপ) করার কথা রয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধির কথা দৈনিক ১ হাজার ৪৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ১০০ কূপের এই পরিকল্পনাটি আগের ৪৮টির তুলনায় অনেক বেশি সুসংহত। কেননা, সরকারি খাতের ৩টি উত্তোলন কোম্পানি-বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফএল) শনাক্ত করা সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় স্থান যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনাটি নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজও ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী, এই ১০০ কূপের মধ্যে নতুন যে ৬৯টি করা হবে, এর ৫২টি করবে বাপেক্স। বিজিএফসিএল করবে ৯টি এবং এসজিএফএল করবে বাকি ৮টি। ওয়ার্কওভার করার জন্য নির্ধারিত ৩১টি কূপ ওই ৩টি কোম্পানি নির্ধারণ করেছে এবং যার যার অংশ সেই সব কোম্পানি বাস্তবায়ন করবে।