আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ একটি ধারাবাহিক সংকট। কোনোভাবেই এ থেকে উত্তরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বহুদিন ধরেই ব্যাংক ও আর্থিক খাত খেলাপি ঋণভারে জর্জরিত হয়ে আছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এমনকি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা কী হবে তা নিয়েও আছে বিতর্ক। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের ব্যাপারে আইএমএফের সংজ্ঞা যদি আমরা গ্রহণ করি, তাহলেও এর পরিমাণ অনেক বেশি হবে। যেসব ঋণ হিসাব পুনঃতফশিলিকরণ করা হয়েছে; যেসব প্রকল্পের ঋণ হিসাব অবলোপন করা হয়েছে এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে পাওনা অর্থকেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) খেলাপি ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করছে। সংস্থাটির মতে, সব ধরনের নন-পারফর্মিং লোনই খেলাপি ঋণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত হবে।
আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭৫ লাখ কোটি বা পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২৫ শতাংশই খেলাপি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব, পুনঃতফশিলিকৃত ঋণ হিসাব এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে দাবিকৃত ঋণের পরিমাণ বাদ দিয়ে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রদর্শন করছে। ফলে সার্বিকভাবে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম মনে হচ্ছে। ব্যাংক খাতের সংকট বোঝার জন্য খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণ নিয়েই হিসাব করা উচিত। আইনি মারপ্যাঁচে হয়তো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো যাবে; কিন্তু সেটা বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন নয়। আমরা আইএমএফের ঋণ নিয়েছি। তাদের দেখানো পদ্ধতিও আমরা গ্রহণ করেছি। কাজেই আইএমএফ যেভাবে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে, আমাদের সেটাই শর্তানুসারে আপাতত মেনে নিতে হবে। কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে না আনা গেলে খেলাপি ঋণ আদায়ে অগ্রগতি হয়েছে এটা বলা যাবে না। আইএমএফের সংজ্ঞানুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছাড়কৃত ঋণের ২৫ শতাংশ। কিন্তু সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আপেক্ষিক পরিমাণ একই রকম নয়। কোনো কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখলাম, দেশের ১৩টি ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোনের পরিমাণ ৩ শতাংশের নিচে। এ ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে ৬টি বিদেশি এবং ৭টি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক। এ ১৩টি ব্যাংকের বাইরে যেসব ব্যাংক আছে, তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের বিচারে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বেসিক ব্যাংক। এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সর্বশেষ হিসাবে কারও কারও মতে প্রায় ৬৬ শতাংশ।
বেসিক ব্যাংক একসময় বেশ ভালো একটি ব্যাংক ছিল। সেই বেসিক ব্যাংকে এত বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ কীভাবে সৃষ্টি হলো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই ঋণের অর্থ পুরোটাই খেলাপি হয়েছে। এক ব্যক্তি যখন কোনো ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে যায়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সেই ব্যক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়তো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তাকে জেলে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু ঋণের নামে নিয়ে যাওয়া টাকা তো আর ফেরত আসে না। ব্যাংক বিপাকে পতিত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাকে মিউচুয়াল হোস্টেজ বলা হয়। ব্যাংক জিম্মি হয়ে গেছে বৃহৎ ঋণগ্রহীতার কাছে আর বৃহৎ ঋণগ্রহীতা জিম্মি হয়ে গেছে ব্যাংকের কাছে।