আমি একজন সিটি ব্যাংকের ছোট শেয়ারহোল্ডার। সেই এক যুগেরও বেশি সময় থেকে আমি এ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আছি। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট উইং আইএফসি যখন এ ব্যাংকের শেয়ার কিনে বোর্ড সদস্য হিসেবে ম্যানেজমেন্টের অংশীদার হয় তখন এ ব্যাংকের প্রতি অন্যদের মতো আমারও আস্থা বেড়ে যায়। আইএফসি বোধ হয় শেয়ারগুলো নিয়েছিল ২৮ টাকা করে। তখন অবশ্য ব্যাংকের এ শেয়ারের মূল্য ৩০-৩৫ টাকার মধ্যে ছিল। যা-ই হোক, আইএফসি আসার পরও আমরা ব্যাংকের আর্থিক সাফল্য অতটা দেখতে পাইনি। শুধু সদ্য সমাপ্ত (২০২৩ ডিসেম্বরে সমাপ্ত) বছরে সিটি ব্যাংক আর্থিক সূচকগুলোয় বেশ ভালো করেছে। কয়েকদিন আগে সিটি ব্যাংকের সিইও একটি সংবাদমাধ্যমের ডিজিটাল প্লাটফর্মে এসে অতি খোশমেজাজে ব্যাংকের সফলতা নিয়ে অনেক কথা বললেন। যেহেতু এ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নিয়ে জানার আমার আগ্রহ ও কারণ আছে তাই আমি সিইও সাহেবের পুরো বক্তব্যই শুনলাম। শুনে একজন ছোট শেয়ারধারী হিসেবে খুশিই হলাম। ভাবলাম সিটি ব্যাংকের খারাপ অবস্থা এতদিনে চলে গেছে। সামনে শুধু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
২০২৩ আর্থিক বছরের জন্য সিটি ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ভালো মুনাফাও ঘোষণা করেছে। ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ স্টক। এটা অনেক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা প্রদানের ঘোষণা। বাজারের এ শেয়ারের মূল্য ১ (এক) টাকা বেড়ে প্রতিটি শেয়ার ২৩ থেকে ২৩ দশমিক ১০ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছিল। অনেকে ভেবেচিন্তে অন্য শেয়ার বিক্রি করে আমি এ মূল্যে সিটি ব্যাংকের আরো কিছু শেয়ার কিনলাম। ২৫ শতাংশ মুনাফা প্রদানের শেয়ারকে পাওয়া যাচ্ছিল মাত্র ২৩ টাকায়। যেকোনো বিবেচনায় আমার কাছে শেয়ারটিকে সস্তা মনে হয়েছিল। আমি নিজেও ভ্যালুয়েশনের একজন শিক্ষক। যেকোনো প্রেক্ষাপট থেকেই বিবেচনা করা হোক না কেন শেয়ারটাকে সস্তা মনে হচ্ছিল। এছাড়া সেদিন সিইও সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল এ ব্যাংকের বোর্ডে আছেন প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ লোকেরা, যারা ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে হস্তক্ষেপ করেন না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিও আছেন ব্যাংকের বোর্ড সভার সদস্য হিসেবে। তিনি এও বললেন যে বোর্ড সভার সদস্যরাই মনে করেন ভালো মুনাফা প্রদানই তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট। এ বক্তব্যগুলো আমাদের মতো বাইরের শেয়ারহোল্ডারদের মনে দাগ কেটেছে। আসলে সব শেয়ারহোল্ডারই দিন শেষে চাইবে ভালো মুনাফা প্রদান। আমার মনে হলো, সিটি ব্যাংক অতীতে খারাপ থাকলেও এখন আর খারাপ নেই। এ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের ওপর আস্থা রাখা যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, ওইসব বক্তব্যের মাত্র দু-তিনদিনের মাথায় সংবাদমাধ্যমে এমন একটা খবর বের হয় যা শেয়ার বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নেননি। খবরটা হলো, সিটি ব্যাংক নাকি ঘুণে ধরা রুগ্ন বেসিক ব্যাংককে অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে। একটা ব্যর্থ ব্যাংক যখন একটা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে তখন স্বাভাবিকভাবে অনেকের ধারণা হবে যে শেষ পর্যন্ত খারাপ ব্যাংকের খারাপ কিছু সবল ব্যাংকে প্রবেশ করে ওইটাকেও দুর্বল করবে। সে ধারণা থেকেই সেদিন বাজারে এ সিটি ব্যাংকের শেয়ারমূল্য ৬০ পয়সা কমে ২২ দশমিক ৪০ টাকায় স্থির হয়। আমি নিজে হতাশ হলাম এবং মনঃক্ষুণ্ন হলাম এই ভেবে যে এ ধরনের একটা সংবাদ বাজারে এলে সিটি ব্যাংকের শেয়ারমূল্যে কী প্রভাব পড়তে পারে তা কি ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট একবারও ভেবে দেখেছে? যেকোনো পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের মূল লক্ষ্যই থাকে শেয়ারহোল্ডার ভ্যালুকে সর্বোচ্চায়ন করা।
উচিত ছিল বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে সিটি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা কীভাবে উপকৃত হবে তার একটি ব্যাখ্যা দেয়া। সিটি ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট বলতে পারে সে ব্যাখ্যার সময় এখনো আসেনি। বিষয়টি অতি প্রাথমিক স্তরে। বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংক একীভূত হয়। কোথাও কোথাও অ্যাসেট কেনার মাধ্যমে অ্যাকুইজিশনও করা হয়। এক্ষেত্রে আমরা বাইরে থেকে যা বুঝলাম তা হলো বেসিক ব্যাংকের বোল্ট ও ব্যবস্থাপনাকে বিলুপ্ত করে কয়েক বছর সিটি ব্যাংক শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে এ ব্যাংককে পরিচালনা করবে। পরে আর্থিক অবস্থায় এ ব্যাংক ভালো হয়ে গেলে একীভূত হওয়ার কাজটা সারানো হবে। তখন ভ্যালুয়ার দিয়ে বেসিক ব্যাংকের সম্পদের ভ্যালুয়েশন করানো হবে এবং স্থায়ী সম্পদের বিপরীতে সম্ভবত সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত শেয়ার ইস্যু করা হবে বেসিক ব্যাংকের মালিকের অনুকূলে। এক্ষেত্রে বেসিক ব্যাংকের মালিক হলো সরকার। এভাবে প্রকৃত অর্থে মার্জ হলে সিটি ব্যাংকের শেয়ারের একটা বড় অংশের মালিক হবে বাংলাদেশ সরকার। এর অর্থ হবে কোনো রকমের স্টক ডিভিডেন্ড ইস্যু না করলেও সিটি ব্যাংকের ইক্যুইটি (পেইডআপ) ক্যাপিটাল অনেক বেড়ে যাবে। আর ব্যবসাও যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে বিষয়টা হয়তো কিছুটা যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু আমাদের ভয় হচ্ছে ইকুইটি বেজ যে হারে বাড়বে, সে হারে ব্যাংকের মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হবে কিনা।