রিকশার শহর ও মসজিদের শহরখ্যাত রাজধানী ঢাকা পরম মমতায় আগলে রেখেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এক সময়ের সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো ঢাকা ক্রমেই যেন হারিয়ে ফেলছে তার শ্যামলিমার সৌন্দর্য। ঢাকায় একদিকে যেমন বায়ুদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। গত বছর ১৫ এপ্রিল ঢাকায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৪-এর ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড তাপমাত্রা করা হয়েছিল, যেটি ১৯৬৫ সালের পর অর্থাৎ ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। হঠাৎ করে এ তাপপ্রবাহ অনেকটা নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ঢাকার বর্তমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল। পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুযায়ী ঢাকা কতটা বসবাস উপযোগী সেটিই এখন মূল আলোচনা। বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বায়ুদূষণের নগর হিসেবে রেকর্ড করেছে ঢাকা। এখন রেকর্ড তাপমাত্রা যেন নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। যেখানে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে, ঠিক একই সময়ে গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপদাহের এ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরগুলোয় দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, যার কারণে সব সময়ই গরম অনুভূত হবে। নগরাঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা নয় বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তন ছাড়াও জনসংখ্যা ও তার ঘনত্ব এবং মানুষের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে কোন স্থানের তাপমাত্রা কেমন হবে। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এ তিন কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে।
বৈশ্বিক কারণের ভেতরে রয়েছে পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজন বন নষ্ট হওয়া, উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় বাণিজ্যিক কারণে কার্বন নিঃসরণ ও জ্বালানি পোড়ানো বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এর জন্য বাংলাদেশ খুব বেশি দায়ী না হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরই পড়ছে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান ও চীন এ জোনে একসময় প্রবহমান অসংখ্য নদী ছিল। কিন্তু দিনে দিনে এ নদীগুলোকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে নদীগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেসব জায়গায় নদী কমেছে তার কয়েকটিতে বালি ভরাট করা হয়েছে আবার কোথাও স্থাপনা তৈরি হয়েছে। ফলে সেখান থেকে প্রচুর তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে বালি থাকার কারণে মরুময় একটি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে এবং এসব কারণে আশপাশের অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ছে। এটি তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রথম আঞ্চলিক কারণ। দ্বিতীয় আঞ্চলিক কারণটি হলো হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া। হিমালয়ের বরফে রিফ্লেক্ট হয়ে তাপমাত্রা পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যেত। কিন্তু এখন বরফ গলে যাওয়ার কারণে সেখানে কঠিন পাথর দেখা যাচ্ছে। ফলে এ পাথরে ধারণকৃত তাপমাত্রা বাতাসের মাধ্যমে আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং এক ধরনের তাপদাহ সৃষ্টি করছে। এ অঞ্চলগুলোয় মেগাসিটি বা শহর বাড়ছে, তারই ধারাবাহিকতায় বাড়ছে যানবাহন ও জনসংখ্যা। যেমন প্রতিবেশী দেশ ভারতের জনসংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশের বেশি এ অঞ্চলে বাস করছে। এ বিপুল জনসংখ্যাকে তাদের নাগরিক সুবিধা দিতে গিয়েও তাপমাত্রা বাড়ছে।
তাপমাত্রা বাড়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা স্থানীয় কারণের, যা স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এ স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা বাড়ার প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া। একসময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ খুবই নগণ্য। গাছপালা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল রাখে। কিন্তু এখন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে রাস্তার বিভাজনের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং একই কারণে বৃষ্টিপাতও কমছে।