২০০৫ সাল। দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলা পাবনার ঈশ্বরদী কেবল জেগে উঠছে ফল-ফসলে। ঈশ্বরদীর এক কৃষক পেঁয়াজ আবাদ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। নাম তাঁর সিরাজুল ইসলাম। তাঁকে সবাই চিনতেন ‘পেঁয়াজ সিরাজুল’ হিসেবে। এর আগেই এলাকায় কৃষি ফসলের সঙ্গে নাম গেঁথে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন ‘পেঁপে বাদশা’। ধনে আবাদ করে বেশ লাভবান কৃষক সিদ্দিকুর রহমান ময়েজও তখন উঠে এসেছেন আমার অনুষ্ঠানের (হৃদয়ে মাটি ও মানুষ) মাধ্যমে।
কুলের মৌসুমে এক সকালে এই সফল কৃষকদের হালহকিকত জানতে যাই। এলাকায় কুল আবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই সম্ভাবনায় বেশ সামনে রয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ। ময়েজের হাতে তখন ব্যাপক যশ ও সম্ভাবনা। অনেকেই আকৃষ্ট তাঁর উৎপাদন কৌশল আর মনোযোগ দেখে। সবাই বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে ময়েজ বড় একটা কিছু দেখাবেন। ময়েজের খেতেই দুজন আগ্রহী নারী কৃষকের সঙ্গে দেখা হলো। যাঁরা কৃষিতে কিছু করতে চান। তাঁদের একজন নুরুন্নাহার। নিতান্তই এক প্রান্তিক কৃষকের স্ত্রী। কৃষির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে স্বপ্ন আছে চোখভরা। বলতে চাইলেন অনেক কথা।
নুরুন্নাহার ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার উপস্থাপিত মাটি ও মানুষের একটি পর্ব দেখেছিলেন—বগুড়ার সালেহা নামের এক নারীর সবজি চাষে সাফল্য। ওই নারী সবজি বিক্রি করে পেয়েছিলেন ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই ১ হাজার ৫০০ টাকা পাওয়ার হিসাবটি নুরুন্নাহারের মাথায় গেঁথে ছিল। দরিদ্র বাবার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে এসেও আরেক দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন নুরুন্নাহার।
স্বামী একটু-আধটু ফসলের আবাদ করেন। কিন্তু হাতযশ কম। ভালো কিছু করতে পারেন না। স্বামীর ঘরে কঠিন দিন পার করতে হয়েছে তাঁকে। মাথার নিচে বালিশের বদলে ইট আর গায়ে বস্তা দিয়েও রাত কাটাতে হয়েছে। দিন কেটেছে খেয়ে না-খেয়ে। সেই নুরুন্নাহার একদিন তাঁর স্বামীর বাগানের কিছু লেবুগাছ কেটে ফেলার কারণে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হন। স্বামীর মারধরের মুখে ওই লেবুগাছগুলোর জন্যই তাঁর জীবনে সবচেয়ে মায়া জন্মে যায়। নতুন করে সালেহার ১ হাজার ৫০০ টাকা উপার্জনের হিসাবটি আবার মাথায় চলে আসে।চিন্তা করেন কৃষিকাজই করবেন তিনি।
নুরুন্নাহারের গল্প শুনে বেশ ভালো লাগল। নতুন একটি পেয়ারাবাগান করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন ধারণ করে এলাম। টেলিভিশনে নিজের অনুষ্ঠান প্রচারের পর নুরুন্নাহারের জীবনে আসে নতুন প্রত্যয়। আশপাশের সফল কৃষকদের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে চাষাবাদে মনোযোগ বাড়াতে থাকেন। সমিতির ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বাড়ির আঙিনায় ফসল আবাদ, বাড়িতে দু-একটি গরু ও হাঁস-মুরগি লালন-পালনের উদ্যোগ নেন তিনি।
এদিকে পরপর কয়েক বছর এলাকায় কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্যের নজির গড়েন সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ। ‘ধনে ময়েজ’ থেকে দেড় কোটি টাকার কুল বিক্রি করে এলাকায় ‘কুল ময়েজ’ হিসেবে নাম ছড়িয়ে যায় তাঁর। ময়েজের সাফল্য বহু কৃষককেই নতুনভাবে উজ্জীবিত করে।
একে একে এলাকায় ‘লিচু কিতাব’, ‘গাজর জাহিদুল’, ‘কফি বারী’, ‘মাছ হাবিব’-এর মতো সফল খামারির নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের সাফল্য এলাকায় এক বড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। ঈশ্বরদীর বখতারপুর গ্রামের সেই নুরুন্নাহারও কিছুটা সাফল্যের আলোয় আসেন। ছোট পরিসরে কৃষি আবাদ করতে করতে আলোর মুখ দেখতে থাকেন তিনি।
২০০৯ সালে সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কারের নির্বাচক কমিটির একজন হিসেবে কৃষিতে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নুরুন্নাহারের নাম দেখলাম। ভালো লাগল ব্যাপারটি। বুঝলাম ঈশ্বরদীর কৃষক সবাই যেমন সাহসী, তেমনি উৎসাহী। তাঁদের ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। ওই সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কারের ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আর গণ্যমান্য মানুষের মাঝে সম্মানপ্রাপ্তি যেন নুরুন্নাহারকে দাঁড় করাল নতুন প্রত্যয়ের পথে। এরপর নুরুন্নাহার এগিয়েই চলেছেন সামনের দিকে। কৃষক হিসেবে নুরুন্নাহারের সাফল্যের খোঁজ পাই, ভালো লাগে।