সমাজ বদলের প্রচেষ্টার একজন সৈনিক ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি আমাদের বন্ধু ছিলেন। কেবল আমাদের নন, বন্ধু ছিলেন দেশের সব মানুষের। তিনি চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। বিলেতে গেছেন চিকিৎসা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য, এগুচ্ছিলেনও, বেশ ভালোভাবেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় এক কাজে জড়িয়ে পড়লেন। সেটাও ব্যাধির চিকিৎসা বৈকি; কিন্তু ব্যক্তির অসুখের নয়, সমাজের অসুখের। সমাজ অসুস্থ ছিল, এখনো আছে, অসুখটা কমেনি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক অসুখের যাতে উপশম ঘটে, এবং অসুখের কারণ যাতে দূর করা যায় সেই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সমাজসেবকদের কথা আমরা শুনতে পাই। নিজেদের আয় থেকে দান করেন এমন মানুষও যে অত্যন্ত বিরল তা নয়; আপৎকালে ত্রাণেও অনেকে এগিয়ে আসেন দেখা যায়; কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরী দাতা বা ত্রাণকর্মী ছিলেন না, সমাজের জন্য তার ভূমিকাটা বন্ধুর। কথায় বলে বিপদেই বন্ধুর পরিচয়, জাফরুল্লাহ চৌধুরী সর্বদাই আমাদের এই বিপন্ন সমাজের মানুষদের পাশে থাকতে চেয়েছেন; অন্য কোনো ভূমিকায় নয়, বন্ধুর ভূমিকায়।
অনেক প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। অবিশ্বাস্য শ্রমে তিনি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ওষুধ প্রস্তুতের কারখানা, ছাপাখানা, মাসিক পত্রিকা, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এসব গড়ে তুলেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানেরই তিনি মালিক নন, এমনকি প্রধান কর্মকর্তাও নন; সর্বত্রই তিনি কর্মীদের একজন, তাদের ভাই, বড়জোর বড় ভাই। উদ্যোক্তা হিসেবে ইচ্ছা করলে অনায়াসে তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ ধনীদের একজন হতে পারতেন; কিন্তু তার চিন্তা কখনোই ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির পথে ধাবিত হয়নি। তার সব উদ্যোগই সামাজিক, উদ্যোগের মালিকানাও সামাজিক। ব্যক্তিমালিকানায় তার আস্থা ছিল না; মালিকানার ব্যক্তিগত ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেই তিনি এগিয়েছেন।
আমাদের সমষ্টিগত জীবনে সবচেয়ে কঠিন এবং সর্বাধিক গৌরবের ঘটনাটি ঘটেছে একাত্তরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধ যখন শুরু হয় জাফরুল্লাহ চৌধুরী তখন চিকিৎসাবিদ্যায় তার উচ্চশিক্ষা প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু গণহত্যা এবং প্রতিরোধ সংগ্রামের খবর শোনা মাত্র সবকিছু ত্যাগ করে তিনি যুদ্ধে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। একা যাবেন না, অন্যদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। যারা যেতে পারবেন না তারা সাহায্য করবেন অর্থ দিয়ে, চিকিৎসার সরঞ্জাম পাঠিয়ে, সম্ভব হলে অস্ত্র সংগ্রহ করে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রবাসী চিকিৎসকদের সংগঠিত করেছেন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন, এবং প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দিতে বেরিয়ে পড়েছেন। মুজিবনগরে চলে আসাটা তার জন্য ছিল দুঃসাহসিক এক সিদ্ধান্ত, এবং কাজটা ছিল বিপদসঙ্কুল। সে কাজ তিনি করেছেন। ওষুধপত্র, চিকিৎসা সামগ্রী এবং অস্ত্রের প্রয়োজন বুঝতে পেরে ফেরত গেছেন ইউরোপে। তারপর আবার তার চলে-আসা যুদ্ধের ময়দানে। ফেরত এসে যুদ্ধাহতদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছেন। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে, সেখানে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা গেছে। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের পর জাফরুল্লাহ দেখলেন যে পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে ঠিকই কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্য অর্জন তখনো দূরেই রয়ে গেছে। মুক্তি’র অর্থ তার কাছে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না, ছিল সামাজিক পরিবর্তন। তিনি একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে সামাজিক বিপ্লবের চেতনাই বুঝতেন।
স্বাধীনতার পর তার অসমাপ্ত শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার জন্য ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাননি, চলে এসেছেন বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হবেন। দেশে ফিরে সাভারে জনগণের জন্য তিনি একটি হাসপাতাল গড়ে তুললেন; সেই হাসপাতাল পরে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হলো। এরপরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন গণ-বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ দিয়ে একটি ওষুধ নীতি প্রণয়ন করালেন, যার ফলে ওষুধ শিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হলো।