আজকাল যাদের ‘কিশোর গ্যাং’ নামে অভিহিত করা হয়, একসময় তাদের বলা হতো ‘বখাটের দল’। সেই সময় এসব বখাটের প্রধান কাজ ছিল গার্লস স্কুলের আশপাশে কিংবা মেয়েদের যাওয়া-আসার পথে নানা রকম উক্তির মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা। তবে সমাজের মুরব্বিদের কারণে এরা বেশি দূর যেতে পারত না।
সহজেই এদের নিবৃত্ত করা যেত। আমি যে সময়টার কথা বলছি সেটা গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক পর্যন্ত। তখন বখাটেরা অনেক সময় দল বেঁধে ঘুরলেও এখনকার মতো গ্যাংয়ের রূপ ধারণ করেনি। মনে পড়ে, ১৯৭৭ সালে আমি যখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তখন একদল কিশোরকে দেখতাম বাজারসংলগ্ন দুই কাঠের ব্রিজের রেলিংয়ে বসে স্কুলগামী মেয়েদের বিব্রত করতে। এদের কাউকে কাউকে চিনতাম।
নিজে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ দু-একজনকে দিয়ে বলিয়েও লাভ হলো না। আমি দৈনিক সংবাদের ‘চিঠিপত্র’ কলামে ‘শ্রীনগরে বখাটেদের উপদ্রব’ শিরোনামে একটি চিঠি লিখলাম। চিঠিটি ছাপা হওয়ার পরে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। যেহেতু আমার অভিযোগে কারও নামোল্লেখ ছিল না, তাই ওই ছেলেগুলো আমাকে কিছু বলে ‘বখাটে’ হিসেবে চিহ্নিত হতে চাইছিল না। তা ছাড়া, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আমার পরিচিতিও ছিল।
তারা গিয়ে শ্রীনগর বাজার কমিটির সেক্রেটারি শামসুল আলম খান তোতা মিয়ার কাছে বলল, আমি এই চিঠি লিখে শ্রীনগরের বদনাম ছড়িয়েছি। সেক্রেটারি সাহেব সম্পর্কে আমার মামা। একদিন ডেকে বললেন, ‘এটা করার আগে তো আমাকে বলতে পারতি?’ তাঁকে বললাম, ‘আমার আগে তো এটা আপনার নজরে আসা উচিত ছিল!’ মামা লা জবাব। বললাম, ‘এখন আপনি ওসি সাহেবকে বলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।’ ওসি সাহেব কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন জানি না। তবে এরপর আর ওই ছেলেগুলোকে সেই অপরাধকর্মে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি।
সেসময়ও কিশোর অপরাধ নিয়ে পত্রিকায় নানান খবর বেরোত। ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন দৈনিক বাংলায় ‘কিশোর অপরাধ প্রসঙ্গে’ শিরোনামে আমার একটি চিঠি ছাপা হয়। তাতে আমি মন্তব্য করেছিলাম, যেভাবে দিন দিন কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, তা যদি কঠোর হস্তে দমন করা না হয়, তাহলে একসময় ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। যত দূর মনে পড়ে, তাতে আমি কিশোর অপরাধীদের সংশোধনাগারে রেখে সংশোধনের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্ব প্রদান, অভিভাবকদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলেছিলাম। প্রসঙ্গত বলা দরকার, সেই সময়ে আমি নিজেও একজন কিশোর ছিলাম।
ওপরের কথাগুলো কারও কারও কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে। কেউ আবার নিজেকে জাহির করার কসরতও মনে করতে পারেন। আসলে তা নয়। মূলত একটি ছোট ঘা সতর্কতা, অবহেলা ও শুরুতে নিরাময়ে তৎপর না হলে যে তা ক্যানসারে রূপ নিতে পারে, সেটা উপলব্ধি করতেই কথাগুলো বলা। বহু আগে থেকেই টঙ্গীতে একটি কিশোর সংশোধনাগার রয়েছে। এখন সেটার কী অবস্থা, জানি না।
সরকারের এই প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত বিপথে যাওয়া কতজন কিশোরকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে, সে পরিসংখ্যানও জানা নেই। হয়তো সে প্রতিষ্ঠানটি এখনো আছে, আছে তার কর্মকর্তা-কর্মচারী, লোক-লস্কর। মাসে মাসে তাঁদের বেতনের টাকা ব্যয় হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। কিন্তু কাজের কাজ কতটা হয় তা বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব থেকেই অনুমান করা যায়।