সম্প্রতি বেশ কয়েকদিন ধরে ভারতের সাধারণ নাগরিকদের বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রীর সূর্যোদয় যোজনা’ বা ‘পিএম রুফটপ সোলার যোজনা’ চালুর বিস্তারিত বিবরণ সোশ্যাল মিডিয়া ইউটিউবে প্রচারিত হয়ে চলেছে। এ বিবরণীতে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ৪৭ হাজার রুপি খরচে তিন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার সোলার প্যানেল বাড়ির ছাদে স্থাপন করতে চাইলে উল্লিখিত যোজনার কাছে আবেদন করার নিয়মগুলো পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ ব্যাখ্যা মোতাবেক মোট ৪৭ হাজার রুপি প্রাক্কলিত খরচের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ হাজার রুপি ভর্তুকি প্রদান করা হবে, আর সোলার প্যানেল স্থাপনকারী ভোক্তাকে ব্যয় করতে হবে ২৯ হাজার রুপি। মোট এক কোটি পরিবারকে ‘পিএম রুফটপ সোলার যোজনায়’ অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত। ইউটিউবে যোজনার পূর্ণ বিবরণ পাঠ করার পর আমার কাছে মনে হয়েছে—মডেলটি সরাসরি বাংলাদেশে প্রয়োগযোগ্য ব্যবস্থা।
বাংলাদেশে বর্তমানে চারটি আমদানীকৃত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এগুলো হলো পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর প্রত্যেকটিই মেগা প্রকল্প, যেগুলো থেকে প্রায় ৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশের জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এ প্লান্টগুলো স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাঝখানে বাংলাদেশ ও বিশ্বের জ্বালানি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অনেকখানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে মারাত্মক ধস নামায় এখন এ বর্ধিত দামে এসব বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেকখানি সংকুচিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ২০২২ সালের আগস্ট থেকে অত্যন্ত কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে নিজেদের বাণিজ্য ঘাটতি ও ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতিকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে। ফলে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কয়লার অভাবে পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ রাখতে হচ্ছে এক বছর ধরে। অদূর ভবিষ্যতেও কয়লা আমদানির এ অপারগতা বজায় থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মনে করা হচ্ছে যে আমদানীকৃত কয়লানির্ভর বিদ্যুতের মেগা প্রকল্প স্থাপনের পুরো ব্যাপারটিই বাংলাদেশের জন্য অসহনীয় বোঝা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা এমনিতেই দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে এরই মধ্যে বড়সড় বিপদে ফেলে দিয়েছে।
ডিজেল আমদানি ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য দেশের ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো ২০২২ সালের জুলাই থেকে বন্ধ রাখা হচ্ছে। এলএনজি-চালিত অনেকগুলো বিদ্যুৎ প্লান্টও বন্ধ থাকছে ডলার সংকটের কারণে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেয়ায়। প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও দৈনিক উৎপাদনকে এখন ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখতে হচ্ছে। এ সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী আমদানীকৃত এলএনজি-নির্ভর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি, যার পাশাপাশি এখন কয়লানির্ভর মেগা প্রকল্পগুলোও বড়সড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, কয়েকজন প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারককে অন্যায্য সুবিধা দেয়ার জন্য এ আমদানীকৃত এলএনজি-নির্ভরতার নীতি গৃহীত হয়েছিল। এ নীতির কারণে দৃশ্যত একদিকে ইচ্ছাকৃত অবহেলার শিকার হয়েছে গ্যাস অনুসন্ধান, আর অন্যদিকে যথাযথ অগ্রাধিকার পায়নি সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ২০২০ সাল পর্যন্ত এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম সস্তা থাকায় হয়তো তখন এ ভুল নীতির অভিঘাত ঠিকমতো উপলব্ধি করা যায়নি, কিন্তু এলএনজি ও কয়লার ওপর এ অতিনির্ভরতা এখন চরম বিপদে ফেলেছে আমাদের। ২০২০ সাল থেকে এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, ২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এলএনজি ঘাটতিও চরম আকার ধারণ করেছিল। অবশ্য এলএনজির দাম এখন কমে প্রতি এমএমবিটিইউ ১০-১২ ডলারে স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। তেলের দামও ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২২ সালের মে মাসে ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, এখন আবার কমেছে। ২০২৪ সালের মার্চে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলারের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে দেশের স্থলভাগে গত ১৪ বছরে কয়েকটি ছোট গ্যাসকূপ ব্যতীত উল্লেখযোগ্য তেল-গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভোলা গ্যাসের ওপর ভাসছে বলা হলেও ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডে আনার কাজটি এখনো শুরু হয়নি! ২০১২ ও ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের বিরুদ্ধে মামলায় জিতে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও মামলায় জেতার পর ১০-১২ বছরে সমুদ্রে গ্যাস-অনুসন্ধান চালানো হয়নি। সম্প্রতি সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করেছে। বলা হচ্ছে, এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগবে। আমরা জানি যে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনের অদূরে মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমা থেকে পাঁচ টিসিএফের বেশি গ্যাস আহরণ করে চলেছে। একই ভূতাত্ত্বিক কাঠামো যেহেতু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও রয়েছে, তাই বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন এলাকার সমুদ্রেও গ্যাস পাওয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় অভিমত। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরের গোদাবরী বেসিনে ভারত এরই মধ্যেই বিশাল গ্যাস ও তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।