মানুষের জীবন থেকেও জীবিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জীবন রক্ষায় জীবিকার বিকল্প নেই। আমাদের দেশ উন্নতির অভিমুখে এগোলেও মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো সংগতি নেই। আমাদের অসহিষ্ণু জাতি হিসেবে যারা দুর্নাম রটিয়েছিল, তারা যে সঠিক বলেনি– বর্তমান বাস্তবতায় তা আর খাটে না। খুচরা সাধারণ দোকানিকে মারধর করলে, গালাগাল দিলে তো সমাধান আসবে না। সমাধান আসবে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সরকারের জরুরি ও কঠিন হস্তক্ষেপে। যেহেতু অসাধু চক্রটি সরকারসংশ্লিষ্ট, তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরিষার মধ্যে ভূত থাকলে সেই সরিষা দিয়ে তো ভূত তাড়ানো যায় না।
রোজার মাসে পণ্যের বাজার আচানক তেজি হয়ে ওঠে। প্রতিবারের মতো এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার তাদের শাসনামলে রোজায় মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হুমকির অতিরিক্ত কিছু করেছে, তেমন দৃষ্টান্ত নেই। তাদের দৌড় ওই হুমকি-ধমকি পর্যন্ত। কৃষক বাদে মধ্যস্বত্বভোগী, পাইকার, আমদানিকারক, আড়তদার, মজুতদার পর্যন্ত চক্রটি দেশে শক্ত ও পাকাপোক্ত আসন নিয়ে বসেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের সংশ্লিষ্টতা আগে যেমন ছিল, এখনও তেমন রয়েছে। বলা যায়, এর মাত্রা বেড়েছে। সে কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের হুমকি প্রদর্শন ব্যতীত করণীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি।
রোজার মাস ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে সংযম সাধনার মাস বলা হয়। অর্থাৎ আহারে, বিলাসে, আচরণে, জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে সংযমের মাস। অথচ আমাদের অভিজ্ঞতা ঠিক এর বিপরীত। আহারে-বিলাসে, অলসতায় নজরকাড়া রোজার মাসের চিত্রটি অভিন্নভাবে আমাদের জীবনে প্রতিবছর ঘুরেফিরে আসে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে রোজার মাস নাকাল করে ছাড়ে। সুবিধাভোগী সামান্য সংখ্যক মানুষদের এ নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তা করতে হয় না। স্বাধীন দেশের সামান্য সংখ্যক স্বাধীনতাভোগী শ্রেণির প্রতিনিধিরা অর্থবিত্ত, সম্পদ, বৈভবের একচ্ছত্র অধিকারী। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, গণমাধ্যম থেকে সরকারের লাগাম পর্যন্ত। এদের বিরুদ্ধে এবং জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি-সামর্থ্য কারও নেই। সে কারণে আমাদের বাজার ব্যবস্থা বণিকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই বাজারের খাদ্যপণ্যের দর নির্ধারিত হয়। বাজারমূল্য এদের ইশারাতেই ওঠানামা করে।
যে কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, সে কিন্তু বাজারের মূল্য অনুযায়ী দাম পায় না। ফসলের মাঠ থেকে মধ্যস্বত্বভোগী ক্ষমতাধর চক্র গড়ে উঠেছে, যারা কৃষকদের দাদন প্রদানে অতি স্বল্পমূল্যে কৃষিপণ্য খরিদ করে থাকে। দাদন অর্থ পুঁজি। পুঁজির দৌরাত্ম্য কৃষকদের অর্থনৈতিক শোষণের মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে আড়ত থেকে সর্বশেষ হাত বদলে খুচরা বিক্রেতার কাছে কৃষিপণ্য পৌঁছানোর পর কৃষকের প্রাপ্ত দামের বহুগুণ মূল্য বৃদ্ধি পায়। সরবরাহ ব্যবস্থাজুড়ে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। হাত বদলে মূল্য বৃদ্ধির অভিনব অপব্যবস্থা কীসের জোরে টিকে আছে– সেটা প্রশ্ন নিশ্চয়। তবে রহস্যপূর্ণ তো বটেই। প্রকৃত রহস্যটি বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা না।