বর্তমান মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী আছেন। তাদের কাজ কী? আবার একই প্রশ্ন অনেক সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষেত্রে ‘উপ’ আছেন, ‘ডেপুটি’ আছেন। আছেন নানা নামে অফিসের দ্বিতীয় পদমর্যাদার ব্যক্তি। এদিকে জাতীয় সংসদে আছে ভিন্ন নামে একটি প্রতিষ্ঠান-যার নাম সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এক কথায় সারা দেশে ভিন্ন সংগঠনে ভিন্ন নামে আছে দ্বিতীয় পদমর্যাদার প্রধান নির্বাহী (সিইও)। এসবে কোনো সমস্যা নেই। তবে প্রশ্ন আছে একটি ক্ষেত্রে, এদের কাজ কী? এবং এরা কি স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার পান, না প্রধান নির্বাহীর আজ্ঞাবহ হিসাবে কাজ করেন? নাকি প্রধান নির্বাহীর সন্তুষ্টি সাপেক্ষে কাজ করেন? এতে সংগঠন বিভাগ, ব্যাংক-বিমা, মন্ত্রণালয়ের কাজের কী কোনো দক্ষতা বাড়ে? সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দৃশ্যত বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ সরকারের। সেখানে মন্ত্রী থাকেন, সিনিয়র সংসদ-সদস্য থাকেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় বলে কাগজে দেখা যায়। প্রশ্ন, ওই সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত কি মন্ত্রণালয়ের জন্য অবশ্য করণীয় সিদ্ধান্ত, নাকি সিদ্ধান্তগুলো পরামর্শমূলক, উপদেশমূলক? এসব প্রশ্ন আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এটা দোষের নয়। অজ্ঞাত কারণে তা হতে পারে। আবার হতে পারে ‘না জানানোর’ ফল। দেখা যায় ব্যাংকে, ব্যাংকে রয়েছে কমপক্ষে দুই-তিন রকমের ‘কমিটি’। ‘নির্বাহী কমিটি’, ‘অডিট কমিটি’ ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ কমিটি। এরাও নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রশ্ন, সিদ্ধান্ত কী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ (বোর্ড) মানতে বাধ্য? না তাদের সিদ্ধান্তগুলোও পরামর্শমূলক? এসব কমিটি কি আসলে ব্যবস্থাপনা দক্ষতা উন্নয়নে কোনো অবদান রাখে? নাকি এসব কমিটিও বোর্ডের চেয়ারম্যানের ‘মনরক্ষা’ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে? প্রচুর প্রশ্ন। সংজ্ঞায় বলে এককথা, বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন কিছু। সংশয় আছে ‘ডেলিগেশন অফ পাওয়ার’ নিয়ে। বাস্তবে কি তা স্বাধীনভাবে বাস্তবায়িত হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটা বাস্তব ঘটনার কথা বলি।
কোনো একসময়ে মতিঝিলের বাণিজ্যিক একটি অফিসে একজন জাঁদরেল প্রধান নির্বাহী আসেন। কেউ কেউ বলেন তিনি হচ্ছেন ‘প্রধান নির্বাহী’ (সিইও)। কেউ কেউ বলেন তিনি ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ (ম্যানেজিং ডিরেক্টর)। অনেকের কাছে তিনি পরিচিত ‘সিইও’ ও প্রেসিডেন্ট হিসাবে। যেভাবেই ডাকা হোক না কেনো, তিনি এসেই দলে দলে বিভক্ত করে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য, জানা ও বোঝা, যা সব নতুনরাই করে থাকেন। কেউ কেউ প্রথমদিনেই কড়া মেজাজ দেখিয়ে ‘বিড়াল মারার’ চেষ্টা করেন। কেউ কেউ নরমভাবে গরম দেখান। কেউ ক্ষমতার উৎস কী তা বুঝিয়ে দেন এ বলে যে, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না’। এমনতর প্রধান নির্বাহী অনেক। সংশ্লিষ্ট প্রধান নির্বাহী বললেন, আপনাদের কাজ আপনারা করবেন। ‘ডেলিগেশন অফ পাওয়ার’ মোতাবেক কাজ করবেন। যার যার দায়িত্ব নির্ভয়ে পালন করবেন। কোনো ভয় নেই, ভীতি নেই। ... চলছে দিন। কর্মকর্তারা অফিসের ‘ডেলিগেশন অফ পাওয়ার’ অনুসরণ করে কাজ চালানো শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই অবস্থা বিগড়ে গেল। দেখা গেল প্রধান নির্বাহীর কাছে লোকজন কম যায়, তদবির কম হয়, ফাইল কম যায়। স্বাধীনভাবে কাজকর্ম শুরুর ফল। প্রধান নির্বাহীর এটা পছন্দ হয়নি। তিনি একদিন সবাইকে ডেকে অনুযোগ করে বললেন, আপনারা কাজ করবেন ঠিকই; কিন্তু আমি কি কিছুই জানতে পারব না? নির্বাহীর ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন সবাই। যারা বুদ্ধিমান তারা তাদের আওতার কাজের জন্যও, সিদ্ধান্তের জন্যও ফাইল প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠাতে লাগলেন। তিনি খুব খুশি। কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি আগের জায়গায় গেল। ‘ডেলিগেশন অফ পাওয়ার’ মাথায় উঠল। অফিস হয়ে উঠল ‘এক নেতার’। প্রধান নির্বাহী মানে ‘প্রধান সেনাপতি’। তার কথাই সব কথা। যারা শুনছে তাদের দাম বেশি। যারা একটু দায়িত্ব খাটাতে চায়, বুদ্ধি খাটাতে চায় তাদের বদলি, না হয় কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে পদায়ন, পদোন্নতিতে বিলম্ব। কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন। আহা, বেশ বেশ!
কেন এসব কথা বললাম? বললাম বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে। নিকট অতীতেই আমরা দেখেছি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বাহাস, বাদানুবাদ। বোধহয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের ঘটনাই হবে। প্রকাশ্যে একজন প্রতিমন্ত্রী নানা অভিযোগ করলেন। তার কোনো কাজ নেই। তিনি বললেন, তার কথা মন্ত্রী শোনেন না। আরও আগের ঘটনা। সেটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের। প্রতিমন্ত্রী গোপনে গোপনে বলতেন ‘আমি ছুটিছাটা দেখার জন্য আছি। আমার কোনো কাজ নেই। মন্ত্রিসভা করেন, প্রেস কনফারেন্স করেন-প্রতিমন্ত্রী অবহেলিত। আরেকবার তো মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্যে বাহাসে নেমে ছিলেন। বাহাস ‘কদর্য’ পর্যায়ে গেলে পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করে সমস্যার সমাধান করেন। এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনের। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, করপোরেশন, বিভিন্ন সরকারি অফিসে, এক নম্বর এবং দুই নম্বর ব্যক্তির মধ্যে রেষারেষি প্রচুর। যেখানে সম্পর্ক ভালো সেখানে দুই নম্বর ব্যক্তিকে বশংবদ হিসাবে কাজ করতে হয়, এক নম্বরের মন জুগিয়ে কাজ করতে হয়। ফলে দেখা যায় ‘দুই নম্বর’ থাকার যে ব্যবস্থাপনাগত যুক্তি, তাই অকেজো হয়ে যায়। ‘দুই নম্বর’ থাকে ‘ম্যান পাওয়ার প্লানিং’-এর মধ্যে যাতে ভবিষ্যতে এক নম্বর তিনি হতে পারেন। কিন্তু এ সুযোগটি সাধারণভাবে উপেক্ষিত। কেউ অফিসে কাউকে ‘প্রমোট’ করতে চায় না। দক্ষতাসম্পন্ন, মেধাসম্পন্ন অফিসার হলে তো রক্ষাই নেই। এক নম্বর সব সময়ই তার খুঁত খুঁজে বেড়াবেন। এক নম্বরের কথা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য হচ্ছে; ক্ষমতা থাকবে সবসময় তার হাতে। যখন তিনি ‘ডেপুটি’ বা ‘প্রতি’ তখন ক্ষমতা থাকবে তার হাতে। আবার একই ব্যক্তি যখন এক নম্বর হবেন তখন ওই ‘ক্ষমতা’ তার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। ছাড়াছাড়ি নেই। ক্ষমতা, ক্ষমতা-চাই ক্ষমতা। দেশ, জাতি, সংগঠন, ব্যাংক-বিমা, বিভাগ করপোরেশন, সর্বত্রই প্রায় এক অবস্থা। অথচ আমাদের দরকার ব্যবস্থাপনার বিকাশ। আমাদের দরকার ক্ষমতাসম্পন্ন অফিসার। মেধাসম্পন্ন অফিসার। অথচ ‘ক্ষমতা’ ব্যবহারের সুযোগ না দিলে যে তা হবে না, এটা আমরা বুঝতে চাই না। আমাদের ব্যবস্থাপনা জগতে এ বিষয়টি সামনেই আসছে না বলে আমার ধারণা। কেউ কাউকে উঠতে দিতে চায় না।