লিঙ্গবৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীর সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের একটি মূল উদ্দেশ্য। এজন্য প্রতি বছরই নির্দিষ্ট একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, যে প্রতিপাদ্যকে ঘিরে পৃথিবীর দেশে দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করার মূল লক্ষ্য সামনে রেখে সমতা অর্জনের জন্য কার্যকর পরিবর্তন আনতে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইনভেস্ট ইন উইমেন : অ্যাকসেলারেট প্রোগ্রেস’, যেখানে নারীদের জন্য বিনিয়োগ করে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রতিপাদ্য খুবই সময়ানুগ ও গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারি, ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জলবায়ু বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা ২০২০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে গুরুতর দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩৪ কোটিরও বেশি নারী ও মেয়েকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হতে পারে। বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইউএন উইমেন-এর ২০২২ সালে করা স্ন্যাপশট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতা অর্জনের জন্য বর্তমান বিশ্ব সঠিক পথে এগোচ্ছে না, যার প্রধান কারণ জেন্ডার সমতা অর্জনের লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দে বছরে ৩৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি। যুদ্ধ-সংঘাত এবং জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা এমন ধারণা করেছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ দেশই নাগরিকদের জন্য ব্যয় কমিয়ে দেবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। দেশে দেশে কমে গেছে সামাজিক সুরক্ষা ও প্রয়োজনীয় পরিষেবা খাতের ব্যয়। তাতে নারী সমাজের ওপর ভয়াবহ কুপ্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের নারীরাও এর বাইরে নয়।
আমরা জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই নারী। কাজেই নারীর জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমান হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অন্যতম মূলনীতি ছিল সমতা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও এ নীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার ও সুযোগ স্বীকৃত হয়েছে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায়ও। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিসত্তা নির্বিশেষে সবাই যাতে সমান অধিকার ও সমান সুযোগ ভোগ করতে পারে, সেজন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) প্রণীত হয়েছে। সিডও সনদে স্বাক্ষরের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছে নারী উন্নয়ন নীতি। দুঃখজনক, এতসব জাতীয়-আন্তর্জাতিক আইনি ও নীতিগত ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখনো নারীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি এবং সমান অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। সামাজিক ক্ষেত্রে নারী এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে পরিগণ্য। নারীর স্বাধীন চলাফেরা এ সমাজে এখনো নির্বিঘ্ন নয়। কারণ, তার সব জায়গায় সবসময় যাওয়া ও সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের অধিকার এখনো সমাজ স্বীকার করে না। তদুপরি, এখনো ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী অবাধে নারীর কর্মোপযোগী পড়াশোনা ও স্বাধীন চলাফেরার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা চালাতে পারে। নারী ও মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে এখনো প্রতিদিন যে পরিমাণ সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তাতে মনে হয়, আমাদের সমাজ এখনো বর্বর দশাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নারীবিরোধী এ সমাজ-সংস্কৃতির কারণে আইনি বাধা সত্ত্বেও বাল্যবিয়ের যূপকাষ্ঠে প্রতিদিন বলি হচ্ছে অজস্র মেয়েশিশু ও কিশোরী। এরকম প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশই নারীকে সমান হয়ে গড়ে উঠতে দেয় না। ফলে তারা সমনাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের সমদুয় নাগরিক সুবিধাদি সমানভাবে ভোগ করতে পারে না। এ প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে নারীর সমান হয়ে ওঠার অনুকূল সামাজিক পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে নারীমুক্তি সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।
অর্থনৈতিকভাবে আমাদের নারীদের বেশির ভাগই পরনির্ভরশীল হয়ে জীবনধারণ করতে বাধ্য হয়; যদিও তাদের শ্রমের ফসল বিনা পারিশ্রমিকে পরিবারের সবাই ভোগ করে। যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক বিধিবিধানের কারণে নারীদের বৃহদাংশই সামাজিক বাধামুক্ত হতে পারে না, ফলে তাদের পক্ষে সাধারণত নির্বিঘ্নে উপার্জনমূলক কাজে অংশ নেওয়াও সম্ভব হয় না। বিয়ে হলে স্বামী-শ্বশুরের সংসারে আর না হলে বাপ-ভাইয়ের সংসারে এদের স্রেফ দাসীর ভূমিকা পালন করে জীবন পার করে দিতে হয়।