মানবসমাজে দিন দিন অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ইদানীং মহামারি আকার ধারণ করছে। একদিকে সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে; অন্যদিকে নারীর অবমাননা বা নারীর ওপর নির্যাতন সমাজে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। নারী নির্যাতন রোধে দেশে বহু আইন রয়েছে। তবুও কেন এত সহিংসতা?
নারী নির্যাতন বলতে সাধারণত নারীদের ওপর দৈহিক, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন বোঝায়। আরও সহজভাবে বলা যায়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নারীরা যখন অন্যের দ্বারা জোরপূর্বক বঞ্চনার শিকার হয় এবং শারীরিক, যৌন ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সে পরিস্থিতিকে নারী নির্যাতন বলা যায়। তথাপি নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেওয়া বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত।
দেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। এ আইনকে ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তি আরও কঠোর করা হয়। এ আইনে বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী ও শিশু অপহরণ, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো ও যৌনপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো এবং ভিক্ষাবৃত্তিসহ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে অঙ্গহানি করা হলে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী শিশুসংক্রান্ত বিধানসংবলিত অপরাধের বিশেষ বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বরে সর্বশেষ সংশোধন করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী নির্যাতন আইন সংশোধন করা হলেও সেখানে আইনের অনেক ফাঁকফোকর ও বৈষম্যমূলক ধারা রয়েছে। বিশেষত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
নারী নির্যাতন একদিকে যেমন নারীর শারীরিক ও মানবিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে, অন্যদিকে তার পরিবার, সন্তানাদি ও অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে কোনো জায়গায়ই নারীরা নিরাপদ নয়। সব জায়গায় নারীরা নির্যাতনের শিক্ষার হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করলে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদকারীর প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। কাজেই বর্তমানে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের বেশ অভাব, ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া ভাব ও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নারীর প্রতি সহিসংসতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তবে যুগ যুগ ধরে নারীদের মনে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজ নারীদের জন্য নয়; নারীরা ঘরের বাইরে গেলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংস হবে। এখনো এ ধারণা বদ্ধমূল রাখার চেষ্টা চলছে।
অনেক সময় আইনের আশ্রয় নিলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী বা তাদের পরিবারের সদস্যদের চাপে অনেক ধর্ষণের তথ্য চাপা পড়ে যায়। এর প্রকৃত চিত্র অধরাই থেকে যায়। আজ অবধি কতজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এর সঠিক তথ্য কিন্তু জাতি জানতে চায়। সত্যিকার অর্থে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঠিকই বেরিয়ে যায়। এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।