কেমন ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ? কেমনইবা ছিল মার্চ মাস? সে বছর মার্চ মাসেও শীতটা যাই যাই করে যাচ্ছিল না। একটা সোয়েটার পরতেই হচ্ছিল। বাইরে একটু একটু শীত কিন্তু ভেতরে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে আমরা ঘুরছি। ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একের পর এক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই চলেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দলমত-নির্বিশেষে সবার দৃষ্টি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে। দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ছোট-বড় সব অফিসই সক্রিয়। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-সরকারি কর্মচারী সবাই জাগ্রত। ৩২ নম্বর থেকে যে সিদ্ধান্তই আসে, তা-ই কার্যকর হয়। আন্দোলন করতে হবে? কোনো কথা নেই। সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর। সারা দেশে এসবের বিরুদ্ধে বলার কোনো লোক নেই। মুসলিম লীগও ভেঙে গেছে।
আইয়ুব খানের তৈরি কনভেনশন মুসলিম লীগ কোথায় যেন গা ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। পাকিস্তানের পক্ষে বলার কোনো মানুষই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের নেতারাও পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তাঁদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা বলে যাচ্ছেন। প্রায়ই তাঁরা ঢাকায় আসছেন। ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করছেন, আলোচনা করছেন। আবার মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কাগমারী চলে যাচ্ছেন। পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার সঙ্গে তাঁদের বঞ্চনাও একাকার হয়ে যাচ্ছে।
দুই ভূখণ্ডেই বেসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। তবে সেনা ছাউনিগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। ইপিআর আর খোদ সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের নিরস্ত্র করার গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমগুলো চলছিল। এই কার্যক্রমের সংবাদ অবশ্য গোপন থাকেনি। দেশে এমন ঐক্য আর কখনো দেখা যায়নি।
সংস্কৃতিকর্মীরা তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানেই প্রয়োজন, সেখানেই আবৃত্তি, গানের সঙ্গে অতীত বিপ্লবী আন্দোলনের কথা বলে যাচ্ছেন। কবিতা, গান রচিত হচ্ছে। গানের সুরারোপ হয়ে যাচ্ছে। পোশাক-পরিচ্ছদও পাল্টে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী হাতে তৈরি তাঁতের কাপড় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিক্ষুব্ধ মানুষ চাইছে একটা পাল্টা কর্মসূচি। পশ্চিম পাকিস্তান ভোটে হেরে গিয়ে শুধু সামরিক ক্ষমতাবলে যা কিছু করছে তার বিরুদ্ধে চাই একটা পাল্টা কর্মসূচি। বিস্ফোরণের আগে বারুদ যেমন জ্বলতে থাকে, তেমনি একটা পরিস্থিতি।
সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের দোতলা থেকে একটি হ্যান্ডমাইকে উপস্থিত জনতার সামনে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জনতা চাইছে আরও সুনির্দিষ্ট কিছু বলবেন তিনি। এই পটভূমিতে আহ্বান এল ৭ মার্চের। স্থান নির্দিষ্ট হলো রেসকোর্স ময়দান। রেসকোর্স ময়দান ছাড়া এত মানুষের স্থান সংকুলানের কোনো উপায় নেই। দুপুরবেলা আমরা পৌঁছানোর অনেক আগেই রেসকোর্স ভরে গেছে। আমরা জায়গা নিলাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ জনতার আনাগোনা দেখছি। নেতা কখন আসবেন, তা প্রথমে একটু অনিশ্চিতই মনে হলো। আগেই বলেছি, শীতটা যাই যাই করেও যাচ্ছিল না। তাই রোদটা অতটা তীব্রও লাগছিল না। এর মধ্যেই দেখা গেল একটি হেলিকপ্টার উড়ছে আকাশে। হেলিকপ্টার দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। একটা সংঘবদ্ধ হুংকার শোনা গেল। এর মধ্যেই দ্রুত নেতা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে উঠে পড়লেন ছোট একটা তৈরি করা মঞ্চে।