সম্প্রতি ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানোর নিমিত্তে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং তা ঘটা করেই সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তা এর আগে প্রণীত বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ‘রোডম্যাপ’, যা ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তারই অংশবিশেষ। রোডম্যাপে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কার এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।
ঘোষিত খেলাপি ঋণ কমানোর নীতিমালায় বেশকিছু শর্ত শিথিলের কথা বলা হয়েছে। প্রধানতম শর্ত হচ্ছে, এখন থেকে যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের মন্দ ঋণ অবলোপনের সময়সীমা কমানো। বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তাদের হিসাবে দেখানো ‘মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে খেলাপি ঋণ’ টানা দুই বছর পর অবলোপন হিসাবে স্থানান্তর করতে পারবে। বলা বাহুল্য, ব্যাংকগুলো এর আগে টানা তিন বছর কোনো ঋণ মন্দ ও ক্ষতিজনক থাকলে অবলোপন করতে পারত। আপাতদৃষ্টিতে শুধু সময়ের মাপকাঠি কমানোর কথা বলা হলেও এর সুদূরপ্রসারী অর্থ এবং হিসাবের মারপ্যাঁচ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, ঋণ অবলোপনের শুধু সময়সীমা কমানোর মাধ্যমেই ব্যাংক খাতে সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণ কমবে প্রায় ২ শতাংশ, যা টাকার অংকে প্রায় ৪৩ হাজার ৫০০ কোটিরও ওপরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঋণ অবলোপনের সময়সীমা তিন বছর থাকায় কোনো ব্যাংকের খেলাপি বা কু-ঋণের হার যদি হয় ১০ শতাংশ, বর্তমানের দুই বছরের সময়সীমা অনুযায়ী ব্যাংকের কু-ঋণের হার দাঁড়াবে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই ব্যাংক তাদের কু-ঋণ কমাতে সক্ষম হবে শতকরা ২ ভাগ। হিসাববিদ্যার আশ্চর্য তেলেসমাতি ছাড়া এ এক প্রচেষ্টাসাধ্য বিষয়।
খেলাপি ঋণ আদায়ে ঘোষিত নতুন নীতিমালায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কিছু কড়াকড়ি এবং কিছু প্রণোদনার কথাও উল্লেখ আছে। যেমনটি বলা হয়েছে যে প্রত্যেক বাণিজ্যিক ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে নিজ নিজ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নেতৃত্বে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ গঠন করবে। ওই অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পারফরম্যান্স বা দক্ষতার ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে মর্মে নীতিমালায় বলা হয়েছে। নীতিমালায় ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের প্রণোদনার বিষয়টি সুস্পষ্ট। অবলোপনকৃত ঋণের আদায়কৃত অংশ ব্যাংক একাধারে আয় হিসেবে দেখাতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন। ৫ শতাংশ প্রণোদনার একটি সুনির্দিষ্ট অংশ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য কোটা হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ঘোষিত নীতিমালার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের মন্দ ঋণ আদালতে মামলা ছাড়াই কু-ঋণ হিসাবে অবলোপন করতে পারবে। মামলাজট থেকে বেরিয়ে এমন নির্দেশনার কারণে ৫ লাখ টাকা বা তার কম অংকের মন্দ ঋণগুলো অবলোপনের নীতিমালায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অবস্থানকে প্রকারান্তরে শক্তিশালী করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকারও বেশি, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ২০ শতাংশের বেশি। এ দেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান। প্রতিবেশী দেশ ভারতে খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কথিত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকায় এ হার ১০ শতাংশের একটু বেশি। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার গত ডিসেম্বরে ৯ শতাংশের কথা বলা হলেও অন্যান্য তথ্যমতে এ হার ১১ শতাংশের মতো।