অপর ভাষার আগ্রাসন যখন বাংলা ভাষায় নেমে এলো, তখন সেই ভাষাকে বাঁচাতে বাঙালি প্রাণ পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করেনি। তবু বাংলা ভাষা অন্তত ভারতে এখন বিপন্ন। কেন বিপন্ন? সে জন্য আমরা হয়তো সঠিকভাবেই দায়ী করতে পারি হিন্দি ভাষার আগ্রাসনমূলক মনোভাবকে। বিশেষ করে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে, তারা এক ভারত, অখণ্ড ভারতের নাম করে হিন্দি ভাষাকেই প্রধান জাতীয় ভাষা করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতিকেও এ দেশের সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জুলুমবাজি চলছে। হিন্দু ফ্যাসিবাদের যে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে মৌলবাদ, তা ছড়িয়ে পড়ছে বাঙালির মধ্যেও।
যদি কলকাতাভিত্তিক বাংলা চ্যানেলগুলো দেখি, সেখানে যেসব রিয়েলিটি শো হয়, সেখানে প্রায়ই শোনা যায় হিন্দি গানের রিমেক। কে কত ভালো হিন্দি গানের রিমেক করতে পারছে, তার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে সে কতদূর যাবে। যেন বাংলা ভাষায় আধুনিক বাংলা গানের আর সমৃদ্ধি নেই। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোতে হিন্দি ভাষাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বাংলা ভাষাকে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে। এখানকার বাঙালিদের মধ্যে ছেলেমেয়েকে বাংলা না শেখানোই যেন একটি আভিজাত্যের প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি পাল্টা সংস্কৃতি কীভাবে গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমাদের মধ্যে থাকা আরও একটি অসংগতির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই হচ্ছে।
যে ভাষার সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক, গর্বের সম্পর্ক, অনুভূতিমালার সম্পর্ক, মানুষ লড়াই করে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে; সেই ভাষার এখন ঠিক কেমন অবস্থা? তার চেয়েও বড় কথা, এই বাংলা ভাষা বলতে ঠিক কোন ভাষাকে বোঝানো হয়?
পশ্চিমবঙ্গে আমরা প্রায়ই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, দক্ষিণবঙ্গ, বাংলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষের টান এবং উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করি। কারণ আমরা মনেই করি– কৃষ্ণনাগরিক যে ভাষা বা কলকাতার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের যে ভাষা, সে ভাষাই হলো প্রধান। আর সে ভাষা নিয়েই আমরা গর্ব করব। এমনকি আমাদের যে গদ্য বা কবিতা রচিত হবে, তাতেও উপস্থিত থাকবে না বাংলার প্রান্তিক মানুষের ব্যবহৃত শব্দ বা অলংকার। এও কি এক ধরনের আধিপত্যবাদ নয়? ভারতের প্রতিটি ভাষাই হোক জাতীয় ভাষা– এ দাবি যদি তুলি আমরা, তাহলে সম্ভবত এ দাবিও তোলা সংগত, একটি ভাষার প্রতিটি আঞ্চলিক উপভাষাকেও সেই ভাষার প্রধান অঙ্গের মর্যাদা দেওয়া হোক।
সিলেটের ভাষা, বিক্রমপুর-ফরিদপুরের ভাষা, চাটগাঁর ভাষা– এ সবকিছুই প্রাকৃতিক অমোঘ সূত্র ধরে এসেছে। ভাষার বিকাশ নিয়ে যারা আলোচনা করবেন, তারা প্রত্যেকেই বলতে পারবেন কেন সিলেট বা চট্টগ্রামের মানুষের বাংলা ভাষা অমন বা কেন পুরুলিয়া বা দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার মানুষের ব্যবহৃত ভাষা বা উচ্চারণ ভঙ্গিমা আলাদা। কিন্তু এ সবই বাংলা ভাষা। যেমন শাসকের হাত ধরে হিন্দি ভাষা আধিপত্য বিস্তার করছে এখন সারা ভারতেই বা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলছে, ঠিক তেমনি পশ্চিমবঙ্গে ভাষার আঞ্চলিক উপভাষাগুলোকে দমন করে রাখাও চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এর কারণ হয়তো কলকাতার আধিপত্যবাদ। কারণ বাংলা ভাষার অন্যান্য উপভাষাকে প্রাধান্য দিলে কোথাও ভাষার যে নগর কর্তৃক শাসন, তাকেও অগ্রাহ্য করা হয়।