বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার পরিচিত একটি দেশ। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে বাংলাদেশে নিয়মিত যে দুর্যোগগুলো লক্ষ করা যায় তা হলো: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, পাহাড় কর্তনজনিত ভূমিধস ও অগ্নিকাণ্ড। বাংলাদেশে নগরে বসবাসকারী প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ এসব প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় এখনো অপ্রস্তুত। দেশব্যাপী অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যেসব অনুষঙ্গ নিশ্চিত করা প্রয়োজন, শহরের অধিকাংশ ভবনেই সেগুলো অনুপস্থিত। ২০০৭ সালের বসুন্ধরা, ২০১০ সালের নিমতলী এবং ২০১৯ সালের চকবাজার ও বনানীর মতো ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডজনিত মৃত্যু প্রমাণ করে আধুনিক যুগেও এ ধরনের নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের মানুষ কতটা পিছিয়ে। নগর দুর্যোগ হলো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কারণে নগর এলাকায় আকস্মিক অথবা ধীরে ধীরে সংঘটিত ঘটনা; যা মানুষের আর্থসামাজিক, সম্পদ ও জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ শহরে বসতি গড়ছে বা শহরমুখী হচ্ছে। ফলে বর্ধিত মানুষের নানা চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে কোনো ধরনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন ও নানা ধরনের অপরিকল্পিত স্থাপনা।
সম্প্রতি দেশের প্রধান শহরগুলোয় অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্যোগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্ট এ অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্যোগ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে যেকোনো স্থানের মানুষ, অবকাঠামো ও সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের কারণে প্রতি বছর ৫০-৬০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় (এফএসসিডি, ২০১৭)। বাংলাদেশের জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিতে ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখাকে আইনি বাধ্যবাধকতায় আনা হয়েছে ২০০৬ সালে। ২০০৩ সালের অগ্নিকাণ্ড রোধ ও নির্বাপণ আইন অনুযায়ী আগুন থেকে সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না পেলে কোনো ভবনকে অনুপযোগী ঘোষণা করার বিধান রাখা হয়েছে এবং এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস বাহিনীকে। শহর এলাকার পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্যোগের সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শহর এলাকার অনেক স্থানে এখন পুকুর, জলাশয়, খাল দখল অথবা ভরাট করে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক, শিল্প ও বাজার এলাকায় পর্যাপ্ত পানির উৎসের অভাবে অগ্নিকাণ্ডের ফলে দেশের নগর এলাকায় মারাত্মক বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। ফলে পর্যাপ্ত পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর শত প্রচেষ্টাও তখন আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হতে পারে।
২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগে আমার তত্ত্বাবধানে সৌরভ হোসেন কর্তৃক এক মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫-পরবর্তী চট্টগ্রাম শহরে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং শর্ট সার্কিট, অসচেতনতা, স্টোর হাউজ, বয়লার বিস্ফোরণ এ নগরীতে অগ্নিকাণ্ডের জন্য প্রধানত দায়ী। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৯২ শতাংশ নগরবাসীর অগ্নিকাণ্ড ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই এবং ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় শহর এলাকায় পর্যাপ্ত পানির সংস্থান করা এ দুর্যোগ মোকাবেলার প্রধান সমস্যা। এছাড়া বিপণিবিতানগুলোর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ বিপণিবিতানে ফায়ার সেফটি ডিজাইন এবং পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। অন্যদিকে ৬১ শতাংশ বিপণিবিতানে কোনো ইমার্জেন্সি ফায়ার ডোর নেই এবং কিছু বিপণিবিতানে জরুরি ফায়ার ডোর থাকলেও অধিকাংশ সময় অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে। শহর এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী সিঁড়ি ও ফায়ার স্টেয়ার ভবনের বাইরে থাকে; এতে আগুন ও ধোঁয়া ভবনে ছড়িয়ে পড়লেও সিঁড়ি ও ফায়ার স্টেয়ারে পৌঁছয় না। ফলে ফায়ার ডোর দিয়ে মানুষ সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের সময় বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় বের হওয়ার পথ না পেয়ে তীব্র তপ্ত ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে। শহর এলাকায় উঁচু ভবনগুলোয় জলাধার এবং স্প্রিংলার (পানি ছিটানোর ব্যবস্থা) থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ ভবনে এগুলো অনুপস্থিত। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ভবনগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি এত নিবিড় থাকে যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়, তাছাড়া একটি ভবন থেকে অন্য ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।