বিশ্ব সামাজিক ফোরাম নাগরিক সমাজ ও সামাজিক আন্দোলনগুলোর বাৎসরিক সম্মেলন যা প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। প্রথাগতভাবে বিশ্ব সামাজিক ফোরামে উপস্থিত সংগঠনগুলো কর্র্তৃত্ববাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে থাকে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর পুঁজির বিশ্বায়ন ও বিশ্ব পুঁজির নেতিবাচক প্রভাবসমূহ যেমন তুলে ধরে এবং এর সূত্র ধরে এই সম্মেলনে বিশ্ব নাগরিক সমাজ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ও সামাজিক আন্দোলনসমূহ তা মোকাবিলায় একাত্মতা প্রকাশ করে। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ায় দাবিসমূহ নিয়ে তারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্ব সামাজিক ফোরাম একটি মুক্ত পরিসর যেখানে মুক্তমত, মুক্ত পথের অনুসারী ও অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনগুলো একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক পৃথিবী গড়ার জন্য আলোচনা, বিতর্ক, পর্যালোচনা এবং ধারণার বিনিময় করে।
এবারের বিশ্ব সামাজিক ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়েছে, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ১৫-১৯ ফেব্রুয়ারি। যেখানে দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা পৃথিবী থেকে মুক্তিকামী মানুষ, ট্রেড ইউনিয়ন, আদিবাসী সংগঠনসহ, নারী সংগঠন, যুব সংগঠন, ভূমিহীনদের সংগঠন, কৃষক সংগঠন, শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, এলজিবিটিকিউআই জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনের আলোচনায় ১৩টি থিমে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণকারীরা তাদের শেষ না ঐতিহাসিক, ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক বঞ্চনার গল্পগুলো শোকগাথা হয়ে উঠে আসে।
এই থিমগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে- অর্থনৈতিক অসমতা ও ন্যায্যতা, শ্রমের মর্যাদা ও অভিবাসন, নব্য দাসত্ব ও পাচার, বর্ণপ্রথা, জাতিভেদ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রান্তিকতা, অস্পৃশ্যতা ও জেনোফোবিয়া, জেন্ডার ও সেক্সুয়ালিটি, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, ভূমির ওপর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, খাদ্য সার্বভৌমত্ব, প্রাকৃতিক কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও প্রাকৃতিক সম্পদ, শান্তি ও সংঘর্ষ, যুদ্ধ, দখলদারিত্ব, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি, যোগাযোগ, ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যম, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও কর্র্তৃত্ববাদিতা, আইন ও ন্যায্যতা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু ন্যায্যতা, বাস্তুসংস্থান, ন্যায্য রূপান্তর, টেকসই উন্নয়ন, নারী, শিশু, যুব, কিশোর-কিশোরী, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, সামাজিক আন্দোলন, নাগরিক পরিসর ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের সম্মেলনে ব্যতিক্রমও আছে। এই প্রথম বিশ্ব সামাজিক সম্মেলনের সব পর্যায় থেকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করা হয় এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কাঠমান্ডুর রাজপথে সেøাগানে অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি এবারের সম্মেলনে জলবায়ু ন্যায্যতা ও পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পায়। সম্মেলনের প্রতিটি পর্যায়ে পুঁজিবাদী লোভ কীভাবে মানুষ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করছে সে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা বিনিময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছিল। সেখানে বারবার উঠে এসেছে পুঁজির বর্তমান কাঠামোর মধ্য থেকে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমাধান খোঁজার জন্য বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার। সেজন্যই বিশ্ব সামাজিক সম্মেলনে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলছে।