এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের আলোচনা-সমালোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তবে এর শুরুটা বছর দুই আগে থেকেই লক্ষ করা গেছে। বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কিছু বাস্তব কারণ তখন ছিল। প্রথমত, করোনার অতিমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কায় পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তৃতীয়ত, বর্তমানে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশ প্রধানত আমদানিনির্ভর দেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক এই সংকটের কালে চরম মুদ্রাস্ফীতি, ডলারসংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের বাজারব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নিয়মনীতিতে পরিচালিত হয় না। সে কারণে আজ একটি পণ্যের দাম বাড়ছে তো কাল অন্যটির দামও বাড়ানো হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাত, ডান হাত, বাম হাত, কালো হাত ও সিন্ডিকেটের হাতের কথা সবারই জানা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে আগে যেটুকু নীতি মেনে চলা হতো, এখন সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। লাভ এবং লোভ কী পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে আমাদের বাজারব্যবস্থায় জায়গা করে নিয়েছে তা সবার জানা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে কোনোভাবেই তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নিম্ন এবং সীমিত আয়ের মানুষদের কেনাকাটায় বড় ধরনের টান পড়ে গেছে। এ নিয়ে সাধারণ এমনকি মধ্যবিত্ত ঘরেও একধরনের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা সহজে মেটানোর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সরকার এক-দেড় বছর থেকে টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যে কয়েকটি পণ্য সরবরাহ করছে। যার সুফলভোগী প্রায় এক কোটি পরিবার। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ—এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অতি ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে এমন সহায়তাও যেন যথেষ্ট নয়। সরকারের পক্ষে এভাবে সব মানুষকে ন্যায্যমূল্যে পণ্যসামগ্রী কেনাকাটার ব্যবস্থা করাও মোটের ওপর অসম্ভব ব্যাপার। সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য নানাভাবে নানা উদ্যোগ নিলেও খুব একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এই সংকটে অনেক দেশ এখন বেশ অস্থিরতার ভেতর দিয়ে সময় পার করছে। আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি গত পনেরো বছরে যথেষ্ট সবল হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক আচরণকে এখনো মানুষ হজম করে চলতে পারছে। মানুষের মধ্যে বাজার নিয়ে অস্বস্তি ও ক্ষোভ আছে, কিন্তু না খেয়ে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এর কারণ হচ্ছে প্রায় দেড় দশক ধরে খাদ্য উৎপাদনে আমাদের বড় ধরনের সফলতা অর্জিত হয়েছে। সে কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও নিয়মিত মুখে অন্ন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যে একদিকে যেমন কিছু বাস্তবতা আছে, অন্যদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতাও গোটা বাজারব্যবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে বাজারব্যবস্থা থেকে অব্যবস্থাপনা, মজুতদারি, কারসাজি, চাঁদাবাজি এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সূক্ষ্ম বিষয়গুলো রোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।