বাংলাদেশে ‘তদবির ইনস্টিটিউট’ নেই, তবে প্রায় সর্বত্র তদবির চলছে মহাসমারোহে। তদবির দিয়ে শুধু চাকরি নয়; উন্নয়নমূলক কাজও পেতে হয়। সে জন্য জাতীয় সংসদে তদবির ইনস্টিটিউট খোলার দাবি জানিয়েছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহাজাদা। তিনি সোমবার জাতীয় সংসদে অভিযোগ করেছেন, উন্নয়নের কাজ বণ্টনে বৈষম্য হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, ‘বৈষম্য থেকে আমার নির্বাচনী এলাকা মুক্তি পাবে– এই প্রার্থনা করি। না হলে জানতে চাই, কীভাবে ডিও লেটার দিয়ে কীভাবে তদবির করতে হয়; এই তদবির করার জন্য কোন ইনস্টিটিউট খুলতে হবে– সেখানে গিয়ে আমরা তদবির শিখব এবং তদবির করে কাজ নেব।’
আমেরিকায় তদবিরের জন্য পেশাদার প্রতিষ্ঠান আছে। তারা অবশ্য তদবির শেখায় না; তদবির করে, যাদের বলা হয় লবিস্ট। আমেরিকায় তদবির বিষয়ে একটি জোকস আছে– ‘ওয়াশিংটন ডিসির ফুটবল টিমের নাম হওয়া উচিত লবিস্টস। কারণ তারা কখনও হারে না।’ দেশটির নিবন্ধিত লবিস্ট ফার্ম আছে কয়েক হাজার। ‘ব্লুমবার্গ গভর্নমেন্ট’ আরও দেখিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এটি একটি শিল্প এবং সেখানে ২০২২ সালে এই তদবির শিল্পের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৪ হাজার কোটি টাকা। বছর দুয়েক আগে যখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের বিতর্ক ওঠে, তখন বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, ‘লবিস্টরা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং এমনকি কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের তথ্য দিয়ে থাকে।’ বাংলাদেশের দলগুলো কে কত টাকার লবিস্ট নিয়োগ করেছিল, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এখন প্রসঙ্গ হলো, তদবিরেই যদি সব কাজ হয়, তবে দেশে তদবির ইনস্টিটিউট না হোক; লবিস্ট ফার্ম কেন নয়? তাহলে অন্তত স্পষ্ট হতো, কারা কী করছে। ২০১৮ সালে সমকালে প্রকাশিত এক লেখায় আমি প্রশ্ন করেছিলাম– তদবির কাজ, না অ-কাজ? আমরা জানি, বিজ্ঞানী নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র বলছে, প্রতিটি ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। অর্থাৎ কাজ সেটাই, যার ফল আছে। সারাদিন দেয়াল ধাক্কিয়ে যদি এক চুলও নড়ানো না যায়, সেটা কাজ হবে না। এ প্রচেষ্টাকে বিজ্ঞান কাজ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। অথচ তদবিরে চাকরি হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, প্রমোশন হচ্ছে। এমন ফলপ্রসূ কর্মকাণ্ডকে তো কাজ বলতেই হবে। নৈতিক ভিত্তিতে সেটা অ-কাজ হতে পারে; কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তদবির একটা কাজ এবং বিরাট শিল্প।
তদবির ‘শিল্প’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ আর আমাদের ক্ষেত্রে ‘আর্ট’। এখানে নানা ধরনের তদবির আছে। কোথাও টাকা, কোথাও মামা-চাচা, কোথাও ক্ষমতা আবার কোথাও উচ্চপদস্থদের ধরে তদবির হয়। এখানেই শেষ নয়। তদবির করতে গিয়ে হাত-পা ধরতে হয়, অনুনয়-বিনয় করতে হয়, অর্থ বা উপহার-উপঢৌকন ঢালতে হয়; জুতা ক্ষয় তো আছেই। যেখানে তদবির ছাড়া কাজ হয় না, যেখানে যোগ্যতা দিয়েও টেকা যায় না। যেখানে অসম প্রতিযোগিতা, বৈষম্য প্রকট, তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়– সেখানে তদবিরই ভরসা।