আমরা যারা অর্থনীতি অধ্যয়ন করেছি কিংবা দৈনন্দিন জীবনে সামষ্টিক অর্থনীতির চর্চা করি, স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে সুদের হার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমবে। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারও কমবে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে হয়তো সেটা বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমাতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। কমিয়ে আনা হয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও। আমদানি কমিয়ে আনা হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি এ সময়ে বাজারে পণ্যের চাহিদারও পতন হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোট বা নগদ অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুনের পর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ কমে আসছিল। কিন্তু অক্টোবরে এসে ছন্দপতন হয়। ওই মাস শেষে বাজারে ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা ছিল ব্যাংক খাতের বাইরে। এর পর থেকে ইস্যুকৃত নোট ও ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়। সে হিসাবে আড়াই মাসের ব্যবধানে ছাপানো অর্থ ১০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত বছরের নভেম্বর থেকে ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকা উত্তোলনের চাপ বেড়ে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনেরও প্রভাব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। অন্যদিকে নানা অনিশ্চয়তার কারণে এক শ্রেণির গ্রাহকও টাকা তুলে নিয়েছেন। অর্থ সংকটে পড়ায় কিছু ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তারল্য সহায়তাও দেওয়া হয়েছিল। এসব কারণে সংকোচনমূলক নীতির পরও ইস্যুকৃত নোটের পাশাপাশি ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোট রেকর্ড ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে ইস্যুকৃত এত পরিমাণ নোট ও ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থ অতীতে কখনোই ছিল না।
স্বাভাবিক কারণেই এত পরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংকের বাইরে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি না। কারণ এক শ্রেণির মানুষ নগদ টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছে। দেশের অর্থনীতির অর্ধেকের বেশি এখনও ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ অবস্থায় সুদহার বাড়িয়ে কিংবা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে এখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।