সমাজে প্রতিটি সম্পর্কই ভালোবাসানির্ভর। কিন্তু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়। ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে বয়স্ক আলোচকরা তাদের কিশোর ও যৌবনকালের প্রেম-পিরিতের গল্প উপস্থাপন করেন।
এমন অনুষ্ঠানে ভালোবাসার বিভিন্নমুখী স্বরূপের ওপর কদাচিৎ গুরুত্ব আরোপিত হয়। ভালোবাসার ক্ষমতাকে যুবক-যুবতীদের বাক-বাকুম প্রেমে সীমায়িত করে ভালোবাসার বিশালতা ও এর শক্তিকে সংকুচিত করা হয়। ভালোবাসার পরিধি কেবল যুবক-যুবতীর প্রেমে সীমাবদ্ধ থাকা যথার্থ নয়। মানুষ তো মা-বাবাকে ভালোবাসেন। ভাই-বোনকে ভালোবাসেন।
আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসেন। প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবকে ভালোবাসেন। ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে এসব সম্পর্কনির্ভর ভালোবাসার ওপর কম আলোকপাত করা হয়। গুরুর প্রতি শিষ্যের, পিরের প্রতি মুরিদের, নেতার প্রতি কর্মীর, আদর্শের প্রতি বিপ্লবীর, শিল্পকর্মের ওপর শিল্পীর এবং ফুল বাগানের ওপর মালির ভালোবাসাকে কি অস্বীকার করা যায়? একইভাবে অস্বীকার করা যায় না এক সহকর্মীর প্রতি অন্য সহকর্মীর, ধান খেতের প্রতি চাষির, নৌকার প্রতি মাঝির, শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর এবং শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের পবিত্র ভালোবাসাকে।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও আজ এ দিবস পালিত হবে। তবে এদেশে এ দিবসটির উদযাপন সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসবের মতো ছড়িয়ে পড়েনি। শহর এলাকার উদারমনা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকে এ দিবস পালন করেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালোবাসা দিবস পালনের যুগপৎ চর্চা ও আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এ দিবস পালন করা হয় না। রাজনৈতিক অঙ্গন যেহেতু প্রতিহিংসা জর্জরিত, সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এ দিবস উদযাপন করে এ এলাকায় বিরাজমান ভালোবাসার খরা লাঘবে উদ্যোগী হলে ভালো হতো।
রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় অনুষ্ঠিত ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে আজ তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের ভালোবাসার রীতি, ভঙ্গিমা ও স্বরূপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। মুরব্বিরা সেকালের প্রেম-পিরিতের সঙ্গে বর্তমান প্রেম-ভালোবাসার তুলনা করবেন। সেকালে প্রেম প্রস্তাবে ব্যবহৃত চিঠির বিলুপ্তি এবং একালের প্রেম পরিণয়ে ব্যবহৃত ডিজিটাল পদ্ধতির ওপরও রসাত্মক আলোচনা হবে। তবে এসব আলোচনায় যুবক-যুবতীদের প্রেম প্রাধান্য পাবে। আলোচনায় উচ্চারিত হবে ভালোবাসার কিংবদন্তি জুঁটি লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রজকিনী-চণ্ডিদাস, শিরী-ফরহাদের নাম। যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মা অসুস্থ জেনে খরস্রোতা নদী সাঁতরে মাকে দেখতে গিয়েছিলেন, সে ভালোবাসার কথা উচ্চারিত হবে কি? এমন আরও অনেক সম্পর্কনির্ভর ভালোবাসার ওপর উল্লেখযোগ্য আলোচনা হবে না। আমি নিবন্ধে যুবক-যুবতীদের প্রেম-ভালোবাসার ওপর আলোকপাত করব না। এর পরিবর্তে শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের ভালোবাসার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করব। নিজে শিক্ষক হওয়ায় বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এ আলোচনার প্রয়াস নেব।
আমি চার দশক (১৯৮২-২০২২) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। অবসর জীবনে শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তাদেরকে এখনো অনলাইনে একাডেমিক সহায়তা প্রদান করি। আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছেন প্রিয় শিক্ষার্থীরা। বর্ণের আবরণে প্রচলিত দলীয় রাজনীতিতে জড়িত না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া, গবেষণা ও শিক্ষকতা ছাড়া আমি অন্য কোনো দায়িত্ব পালন করিনি বা করার সুযোগ পাইনি। কারণ, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদ এবং সুযোগ-সুবিধা মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ডে বণ্টন হয় না। হয় রাজনৈতিক বর্ণ পরিচয়ের বিচারে। এ কারণে আমার ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবন শ্রেণিকক্ষ ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। পাঠদান ছাড়া অন্য দায়িত্ব না থাকায় আমি আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে যত্নের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি। তাদের সমস্যা অনুধাবনের জন্য বন্ধুর মতো তাদের সঙ্গে মিশেছি।