ড. আশিকুর রহমান অর্থনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদ। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ইকোনমিস্টস ফোরামের (বিইএফ) সদস্য সচিব। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর পিএইচডি লাভ করেন। তিনি বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, ইরি ও জাইকা। সাম্প্রতিক অর্থনীতির নানামুখী সংকট ও নতুন বছরে নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন বণিক বার্তায়।
গত বছর অনেকগুলো অবকাঠামো চালু হয়েছে। এসব অবকাঠামো অর্থনীতিতে গতিশীলতা বৃদ্ধি করবে। সমালোচকরা বলছেন, এখানে বড় অংকের ব্যয় হয়েছে। ঋণ হয়েছে। বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয় অনেক ঋণ হয়েছে। উচ্চ সুদে খুব দ্রুত পরিশোধ করতে হবে। ফলে আমরা আরো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পড়ব কিনা।
ড. আশিকুর রহমান: আমি এ ঋণগুলো নেয়াকে কোনোভাবেই নেতিবাচকভাবে দেখি না। আপনার ঋণ নেয়ার যোগ্যতা আছে বলে আপনাকে ঋণ দেয়া হয়েছে। আপনি টাকা ফেরত দিতে পারবেন বলে আপনাকে মানুষ ঋণ দিয়েছে। আপনি এ টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু বানিয়েছেন, মেট্রোরেল বানিয়েছেন। বিদ্যুৎ খাতের নির্মাণে ব্যয় করেছেন, এখন এগুলো সব আপেক্ষিক কথাবার্তা যে ১০ টাকায় বিনিয়োগ হয়েছে বা ১২ টাকায় বিনিয়োগ হয়েছে, না ৯ টাকায় করতে পারত। আমাদের দেশে একটা পদ্মা সেতু নিজের টাকায় তো কেউ করতে পারেনি। এ সরকার পেরেছে। কোনো সরকার মেট্রোরেল দিতে পারেনি। একটা সরকার পেরেছে। কোনো সরকার নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট করতে পারেনি। এ সরকার পেরেছে। কেউ বেশি টাকায় পারত কেউ কম টাকায় পারত, এটা সবই আপেক্ষিক আলোচনা।
আমি সেই আপেক্ষিক আলোচনা বা রিয়েলেটিভ ডিসকাশনে যেতে চাই না। আমি মনে করি, আমাদের যে ইনভেস্টমেন্টগুলো হয়েছে তার দৃশ্যমান ফল মানুষ পাচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ের ফল ঢাকাবাসী পাচ্ছে। মেট্রোরেলের ফল ঢাকাবাসী পাচ্ছে। পদ্মা ব্রিজের ফল আমরা যারা ভোলা যাই বা বরিশাল যাই তারা পাচ্ছি, এ ফলগুলো আমরা পাচ্ছি।
কিন্তু আমরা তো ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণে পড়লাম। বিশাল অংকের এ ঋণের কী ঝুঁকি দেখছেন?
ড. আশিকুর রহমান: হ্যাঁ, এটাকে আরো ভালোভাবে করা যায়, সব জায়গায় এ যুক্তি দেয়া যায়, কিন্তু আপনি যে পয়েন্টটা বলছেন যে আমার ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণ হওয়ার কারণে আমার কোনো সামষ্টিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি (ম্যাক্রোইকোনমিক রিস্ক) তৈরি হয়েছে কিনা। এ ঝুঁকি তো এক বছর আগে পর্যন্ত ছিল না। ঝুঁকি তা এল গত দুই বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ভুল নীতির কারণে। গত দুই বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার আমাদের রিজার্ভ থেকে চলে গেছে। আজকে আমরা বিনিময় হারের (এক্সচেঞ্জ রেট) ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আমরা সুদের হারের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ২০২২ সালের মার্চে যদি আমরা বিনিময় হার এবং সুদের হারের ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারতাম, যেটা ভারত নিয়েছে, যেটা পৃথিবীর ৫০টা দেশ নিয়েছে তাহলে এ ১৮ মাসে ২০ বিলিয়ন ডলার আমি হারাতাম না। সেই ২০ বিলিয়ন ডলার যদি আমি না হারাতাম ১০ বিলিয়ন ডলার হারাতাম বা ৮ বিলিয়ন ডলার হারাতাম বা ১২ বিলিয়ন ডলার হারাতাম। তাহলে আমার রিজার্ভ ৩০-এর ঘরে থাকত বা ২৫-এর ঘরে থাকত বা ২৮-এর ঘরে থাকত। আমার রিজার্ভ যদি ৩০, ২৫ বা ২৮-এর ঘরে থাকত তাহলে আমাদের জন্য বৈদেশিক ঋণ কোনো সাবজেক্ট ছিল না। সুতরাং আজকে যে ঋণের প্রশ্নগুলো আসছে, সেটা এসেছে কারণ সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা (ম্যাক্রোইকোনমিক ম্যানেজমেন্ট) গত এক বছর ভুল হয়েছে, এটার সঙ্গে মেগা অবকাঠামোর (ইনফ্রাস্ট্রাকচার) কোনো সম্পর্ক নেই। আমার যদি মেগা অবকাঠামো আমি না বানাতাম তাহলে কি বাংলাদেশের এ ১৫ বছরে এ অর্থনৈতিক উন্নয়ন আপনি দেখতে পারতেন। ২ হাজার ৫০০ ডলার মাথাপিছু আয় হতো? হতো না তো। এ প্রত্যেকটা বিনিয়োগের একটা চুইয়ে পড়া প্রভাব আমার কাছে গেছে, আপনার কাছেও গেছে। আমরা হয়তোবা এটা বুঝতে পারছি না, ইকোনমিতে ডিমান্ড তৈরি হয়, ডিমান্ড হলে উৎপাদন তৈরি হয়, উৎপাদন হলে চাকরি হয়। এটার চুইয়ে পড়া সুবিধাগুলোও সবাই পাচ্ছে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে কয়টা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল। আজকে কয়টা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। আর ১৫ বছর আগে কয়টা স্টিল ফ্যাক্টরি ছিল, আজকে কয়টা স্টিল ফ্যাক্টরি আছে। এগুলোর জায়গায় কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি? কয়টা সিরামিক ফ্যাক্টরি ছিল। আজকে কয়টা সিরামিক ফ্যাক্টরি আছে। কয়জন পাথর আমদানি করত, কয়টা ঠিকাদারি (কন্সট্রাকশন) কোম্পানি ছিল। আজকে কয়টা আছে। এই যে বিনিয়োগগুলো হয়েছে, বিনিয়োগগুলো হওয়ার কারণেই তো এ কোম্পানিগুলো তৈরি হয়েছে, কর্মসংস্থানগুলো তৈরি হয়েছে। এটাকে আমরা সমস্যা মনে করি না। আমাদের সমস্যাগুলো সুশাসন। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন—এ দুই জায়গায় আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার দেখাতে হবে। আমাদের যে অর্থনৈতিক ভিশন-২০৪১ সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে, যদি আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটা অর্থনৈতিক পরিবর্তন চাই, যদি আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতগুলোর মতো মৌলিক খাতগুলোকে একদম ঢেলে সাজাতে চাই তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া বা অর্থ ব্যবস্থাকে দুর্বল রেখে আমরা কোনো বড় অর্থনৈতিক নেতৃত্ব নিতে পারব না।