সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির পর মেক্সিকোর কবি অক্টাভিও পাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নোবেল প্রাইজ কাউকে অমরত্বের পাসপোর্ট দেয় না, কিন্তু তাঁর সাহিত্যকে বৃহত্তর পাঠকের কাছে নিয়ে যায় এবং এটাই একজন লেখকের প্রাপ্তি’। তিনি এ-ও বলেছিলেন, তিনি পুরস্কারের জন্য লেখেন না, লেখেন তীব্র এক প্রেষণা থেকে এবং সেই প্রেষণা হলো সৌন্দর্য সৃষ্টির ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার।
সৃষ্টি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যও মোটামুটি একই রকম। মৃত্যুর আগে পৃথিবীকে আরও একটু সুন্দর করে রেখে যাওয়ার গভীর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন তিনি। কবিতার ভাষায় তিনি বলছেন:
ধরণির তলে গগনের গায়
সাগরের জলে, অরণ্য-ছায়
আরেকটু খানি নবীন আভায়
রঙিন করিয়া দিব।
সংসার-মাঝে দু-একটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে সাহিত্যচর্চাই করেছেন ২৮ বছর। ২৮ বছরের সাহিত্যিক জীবনে ৫৭টি গ্রন্থ রচনা করা অসম্ভব কিছু নয়; কিন্তু শিল্পের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ এ সব গল্প-উপন্যাস সুবিশাল। শিল্পমান অক্ষুণ্ন রেখে এই বিশাল সম্ভার কীভাবে সম্ভব হলো—আমাদের সময়ের শিল্পী-সাহিত্যিকদের তা বোঝা দরকার।
সৃষ্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, সাধনা করাই মহৎ সৃষ্টির মূলমন্ত্র। আর সৃষ্টি ও কর্মের মধ্যে একটি আন্তসম্পর্ক আছে। মহৎ চিন্তাই যথেষ্ট নয়। মহৎ চিন্তার প্রতিফলন থাকতে হয় কর্মে। তাহলে কর্মও মহৎ হয়ে ওঠে। মহৎ চিন্তা উন্নত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। উন্নত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা শুধু নিজের জন্য নয়; বরং সবার জন্য। সব মানুষের জন্য উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন মার্ক্সবাদে, যুক্ত হয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টিতে, আজীবন কাজ করেছেন মানুষের মুক্তির জন্য।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ছাড়া একজন সাহিত্যিকের সৃষ্টি পূর্ণতা পায় না। এর জন্য দুটি জিনিস যুগপৎ দরকার। মহৎ সৃষ্টির সঙ্গে প্রয়োজন মহৎ কর্ম। এটাই সম্ভবত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনদর্শন। এই জীবনদর্শনই ধারণ করেছিলেন পাবলো নেরুদা, জ্যঁ পল সার্ত্রে, মাক্সিম গোর্কি—এমনকি বার্ট্রান্ড রাসেল ও গ্রাহাম গ্রিনরাও।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন প্রলেতারিয়েত মনে প্রাণে। পার্টি ফান্ডে পৈতৃক বাড়ির অংশীদার হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ দান করে দিয়েছিলেন। নিজের চাকরি নেই, খাবার টাকা নেই, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠলে হাসপাতালে নেওয়ার মতো ভাড়াও পর্যন্ত ছিল না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অথচ কমিউনিস্টদের পত্রিকায় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য হিসেবে নিরলস কাজ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ক্লান্ত-শ্রান্ত এই কলমযোদ্ধা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’
আর আজকে কী দেখছি চারদিকে? বাংলাদেশে আজ বুদ্ধিজীবী তথা লেখক-গবেষক-কবিকুলের অনেকেই বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত যেমন আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী, জামাতপন্থী, বামপন্থী, ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, চীনপন্থী, আমেরিকাপন্থী, সৌদিপন্থী, ইরানপন্থী ইত্যাদি।