দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছে তীব্র জ্বালানি সংকট। শিল্প ও আবাসিক উভয় ক্ষেত্রে জ্বালানি গ্যাসের প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। ভুলে গেলে চলবে না, শিল্পের উৎপাদন বন্ধ হলে অর্থনীতির প্রাণভোমরা তথা তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাংলাদেশ বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।
চলতি বছরের শুরুতে সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক অর্থনীতি বিশ্লেষক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব বিপদের আশঙ্কা উপস্থাপন করা হয়েছে সে তালিকার প্রথমে স্থান পেয়েছে জ্বালানির জোগান সংকট। বাংলাদেশি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সহায়তায় সম্পন্ন হওয়া এ জরিপের ফলে মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতির গতিপথের নিম্নমুখী গন্তব্য, ধন ও আয়বৈষম্য, মাথাপিছু ঋণ বাড়ার চেয়ে অনাগত দিনগুলোয় জ্বালানি সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় বিপদের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের জোগান মাত্র ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে, সর্বোপরি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশে শিল্পে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। তবে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে শিল্পের উৎপাদনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রাখার মতো সংকট হয় না।
ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে বেশির ভাগ শিল্পের প্রডাকশন প্ল্যান্ট অবস্থিত। ডায়িং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং, স্পিনিং মিলগুলোর উৎপাদন জ্বালানি সংকটের কবলে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন মোট সক্ষমতার ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। উৎপাদন চালু রাখতে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার কিংবা ডিজেল ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন অধিকাংশ শিল্পোদ্যোক্তা। বিকল্প জ্বালানি প্রায় নিয়মিতভাবে ব্যবহার করার ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। তবু ক্রেতাদের ধরে রাখতে ক্ষতির শিকার হয়ে অসংখ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয়, জ্বালানি গ্যাসের সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে অনন্তকাল এভাবে ক্ষতি গুণে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তখন নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান আমাদের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, তুরস্কের মতো দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রহী হবে। তখন আমাদের অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র তৈরি পোশাক শিল্পে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটলে দেশের নাগরিকদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানে দ্রুতই ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করার আশঙ্কা রয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্প ছাড়াও অসংখ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেও গ্যাস প্রয়োজন হয়। গণ-পরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনের রূপান্তরিত জ্বালানি হিসেবে সিএনজির বহুল ব্যবহার হয়। তাই জ্বালানি হিসেবে গ্যাস সংকটের তীব্র প্রভাব পড়তে বাধ্য। আমাদের দেশের মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের শিল্প ও আবাসিক খাতের জ্বালানি নিরাপত্তা দীর্ঘদিন ধরে যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করা যৌক্তিক কি না এ প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের চিন্তিত করছিল। কিন্তু এরই মধ্যে খবর হচ্ছে যে একটি বাংলাদেশি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে মিলে আরেকটি মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সাল থেকে এ যৌথ উদ্যোগ ১৫ বছর বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহ করার দায়িত্ব পাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশি বেসরকারি কোম্পানিটির এর আগে রূপান্তরিত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রমাণ থাকার পরও কেন একই কোম্পানিকে এলএনজি আমদানির অনুমতি ও ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে?