২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে যে দিনগুলোতে উদ্দীপিত, আলোড়িত এবং অভিভূত হওয়ার আছে তারই অন্যতম একটি দিন ২০ জানুয়ারি।৫৫ বছর আগের দিনটি স্মরণে কবি শামসুর রাহমান তাঁর পঞ্চম বই ‘নিজ বাসভূমে’ (আমার নিজের দেশে) ‘আসাদের শার্ট ’ কবিতায় আসাদের রক্তে ভেজা শার্টকে চিত্রিত করে লিখেছেন, ‘গুচ্ছ গুচ্ছ করবীর মতো কিন্তু সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় উড়ছে, উড়ছে অবিরাম আমাদের হৃদয়ে রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।’প্রকৃত নাম আমানউল্লাহ আসাদুজ্জামান ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক দিনটিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।আর তাঁর মৃত্যুই আমাদের অধিকার আদায়ের রাস্তায় অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা আগুনের তাপে জনতা জেগে পাকিস্তানি শাসকদের ভিত নড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু মুক্ত হন কারাগার থেকে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আইয়ুব শাহীর পতনের দাবিতে গণআন্দোলনে পথিকৃৎ পুলিশের গুলিতে নিহত হন আসাদ।এরপর থেকেই এ দিনটি শহীদ আসাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।ওই সময় আরো দুজন শহীদ হন। শহীদ রুস্তম ও শহীদ মতিউর। বাম গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আসাদ শুধু ছাত্র নন, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যেও রাজনৈতিক কাজ শুরু করেন।আমানউল্লাহ আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র সেদিন নির্ভীক চেতনায় অগ্রসর হয়েছিলেন মানব মুক্তির সোপানে।জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে ছাত্র-জনতার সম্পৃক্ততা গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।বিশেষত ৬-দফার মধ্য দিয়ে।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কৌশলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। জনতার অধিকাংশই ছিল নিম্নবর্গ জনগোষ্ঠী। ছাত্ররা ছিল কৃষিভিত্তিক বাংলার সাধারণ পরিবারের সদস্য, এছাড়া শ্রমিক জনতার সম্পৃক্ততা ৬ দফাকে এক দফায়(স্বাধীনতা) পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে এদেশের বামপন্থী রাজনীতির জায়গায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় সূচিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতাকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিলেন আত্মত্যাগের রাজনীতি করে।
১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। পুনরায় তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সূচনা ঘটে ছয় দফাকে কেন্দ্র করে।প্রস্তাবিত ছয়-দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ।১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।তিনি ছয়-দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা পূর্ববাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন।এ সময় তাঁকে সিলেট, যশোহর, ময়মনসিংহ ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বার বার গ্রেফতার করা হয়।শেখ মুজিব এ বছরের প্রথম তিন মাসে আট বার গ্রেফতার হন।এবার তিনি একনাগাড়ে প্রায় তিন বছর কারাবাস করেন।৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে এবং ছয়-দফার সমর্থনে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় ঢাকার তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে মনুমিয়াসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন।এই দিনই বাঙালির আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ছয়-দফা বাংলাদেশের মহাসনদে (ম্যাগনাকাটা) পরিণত হয়।এই ছয় দফার ফলাফল হলো ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর জেলমুক্তি, এর ফলাফল হলো সত্তরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের জয় লাভ, আর তারপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার শেষ পরিণতি অর্জন।৬ দফার শেষ দফায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তিনি মানুষের খাদেম; জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাকি জীবন ত্যাগ করতে পারবেন।তিনি ১৯৬৬ সালে কারাগারে থেকেও দেখেছিলেন ছয় দফা দাবির জন্য মানুষকে রক্ত দিতে এবং আন্দোলন পরিচালনা করতে।একারণে ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও প্রতিবাদী চারিত্র্য আকস্মিক কোনো ব্যাপার ছিল না। আসাদের আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরই উদ্দীপিত রূপ।১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।আসাদ ছিলেন এই সংগ্রাম পরিষদেরই একজন আত্মত্যাগী নেতা।