গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের দেশে একধরনের আদিখ্যেতা আছে। আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলি বটে, তবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি আমাদের প্রকৃত আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। আমাদের কাছে গণতন্ত্র হলো পাঁচ বছর পর ভোট দিতে পারা।
ভোট দিয়ে কাউকে জিতিয়ে বা কাউকে হারিয়ে দিতে পারলেই আমরা খুশি। যাঁদের আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি, তাঁরা আচার-আচরণে কতটুকু গণতান্ত্রিক তা আর আমাদের দেখার বিষয় নয়। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে দেখুন। দল পরিচালনায় গণতন্ত্রের তেমন চর্চা আছে কি? দলের সম্মেলন নিয়মিত হয় না। নির্ধারিত সময়ের পরে যদিওবা সম্মেলন হয়, কিন্তু কমিটি গঠন হয় না। সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বা চেয়ারপারসন ও মহাসচিব নির্বাচন করে পুরো কমিটি গঠনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনের পর দিন।
সম্মেলনে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠন করা হয় না কেন? দলীয় সভাগুলোতে দলপ্রধানের ইচ্ছার বাইরে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত কি গ্রহণ করা হয়? আলোচনা হয়, বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মত দেন এবং তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় দলীয় প্রধানের ওপর। এটা কেমন গণতন্ত্র? আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্র হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে বিএনপি ক্লান্তিহীন। বিএনপি কবে, কীভাবে গণতন্ত্রকে উজ্জীবিত করেছে, সে প্রশ্ন করা যাবে না। মোটাদাগে আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গণতন্ত্র মানে একে অপরের লাগামহীন বিরোধিতা করা। বিএনপি গণতন্ত্র বলতে বোঝে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো। আর আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র হলো বিএনপিকে যেকোনোভাবে প্রতিরোধ করা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই কার্যত শক্তি প্রয়োগের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। ভোটের মাঠেও কিন্তু এই শক্তির প্রতিযোগিতাই বড় হয়ে ওঠে। একসময় রাজনৈতিক দলগুলোতে কিছুটা হলেও নীতি-আদর্শের প্রতিযোগিতা ছিল। দিন দিন সেটা কমে আসছে। এখন প্রতিযোগিতা অর্থের। আগে রাজনীতিবিদেরা ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা নিয়ে দল চালালেও ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত হতেন না। কারণ মনে করা হতো রাজনীতি ও ব্যবসা এক নয়। ব্যবসার মূল লক্ষ্য মুনাফা আর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ। এখন রাজনীতিই হয়েছে ব্যবসা। তাই ব্যবসায়ীরা আর চাঁদা দিয়ে মন্ত্রী লালনপালন না করে নিজেরাই মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে যোগ দিয়েছেন।
জনকল্যাণ এখন আর রাজনীতির লক্ষ্য নয়। রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতা আর ক্ষমতা মানেই দুর্নীতি। এই যে বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের লুটপাটের বিরুদ্ধে এত গলা ফাটাচ্ছে, এটা কি এ জন্য যে তারা ক্ষমতায় গিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে? না, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।
তারা ক্ষমতার বাইরে থাকায় বড় ধরনের দুর্নীতি করতে পারছে না। এখন মনোনয়ন দিয়ে কিংবা দলের পদ বিক্রি করে সবাই তো দুর্নীতি করতে পারছে না। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে এখন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ যেমন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তেমনি বিএনপির লোকজনও হতে চান। সে জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে যেকোনো উপায়ে টেনে নামানোর জন্য বিএনপির এত আকুলতা। কেউ যদি মনে করে থাকেন, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কিংবা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য, তাহলে ভুল ভাবছেন।