বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নকামী কল্যাণ অর্থনীতিতে সব পক্ষকে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। একই সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার লক্ষ্যে সুশাসন ও আত্ম বিশ্লেষণের বিকল্প নেই। বিশেষ করে ২০২৩-এর তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪-এ অচল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ‘নিজের দিকে নিজে তাকানো’ অনিবার্য এই মুহূর্তে। বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল, সুদান সমরেরকালে প্রত্যেক দেশ ও অর্থনীতিকে পরনির্ভরশীলতার পরিবর্তে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অনিবার্যতা দেখা দিচ্ছে। যে কোনো ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলেই যে কোনে উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ঘাটতি বা ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্যপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভু হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
করোনা-উত্তরকালে বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তি ও সম্পদে পরিণত করা না যায়, তাদের উপযুক্ত শিক্ষা, কর্মক্ষমতা, দক্ষতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ যদি সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে সর্বত্র। উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। ক্ষমতা, পদ-পদবি অর্জনকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে তা পাওয়া, থাকা বা রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়িত্বহীন সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণিনির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ সাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক, সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কীভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা কোনোভাবেই সুস্থতার লক্ষণ নয়। এখনো মুমূর্ষু গণতন্ত্রকে বাঁচানোর নামে নির্বাচনে অঢেল অর্থ ব্যয় চলে। তা যেন এমন এক বিনিয়োগ, যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগদানের সমতুল্য। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বঞ্চিত নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিতচিত্ত হওয়ার বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বই যখন উৎপাদনবিমুখ আর শ্রমিক স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভু বনে যায়, তখন দেখা যায়, যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচণ্ড স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একটি ভালো সংগীত সৃষ্টিতে গীতিকার সুরকার গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রীর সমন্বিত প্রয়াস যেমন পরিহার্য, তেমনি দেশ বা সংসারের সামষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বা পুনরুদ্ধারে সব পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া সুচারুরূপে সম্পাদন সম্ভব নয়। আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার বেলাতেও এমনকি যে কোনো উৎপাদন ও উন্নয়ন উদ্যোগেও ভূমি, শ্রম ও পুঁজি ছাড়াও মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের সমন্বিত ও পরিশীলিত প্রয়াস প্রচেষ্টাই সব সাফল্যের চাবিকাঠি বলে বিবেচিত হচ্ছে। মানব সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের দ্বারা দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়াসে সুসমন্বয়ের আবশ্যকতা অপরিহার্য। স্থান-কাল-পাত্রের পর্যায় ও অবস্থানভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করাও সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার একটা অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ হওয়া উচিত।