অনেক আশা নিয়ে মানুষ পরবর্তী বছর, পরের মাস, এমনকি পরের দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। ভাবে, হয়তো আগামী দিনটি সুখের দিন হবে, আগামী মাসটি সুখের হবে, আরও সুখের হবে আগামী বছর। এমনি করে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। কারও জন্য হয়তো সুদিন আসে। অধিকাংশের জীবনে আবার জমতে থাকে হতাশার স্তূপ। আবার অধিকাংশ মানুষের জীবনে আঁধারের কাল শেষ হয় না। কারও কারও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো সৌভাগ্যের বৃষ্টি ঝরতে থাকে, যাকে সোজা বাংলায় বলা হয় ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। সে-ও খুবই মুষ্টিমেয় লোকের জন্য। এই মুষ্টিমেয়রাই আবার একসময় একটা বড় শ্রেণিতে পরিণত হয়। অবশ্যই তাদের পেছনে থাকে শাসকগোষ্ঠী।
সব শাসকগোষ্ঠীর আমলেই একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়ে যায়। দেশের সম্পদের একটা বড় অংশের মালিক হয়ে যায় তারা। ‘থার্টি ফার্স্ট’ তাদের জীবনে অফুরন্ত আনন্দের সময়। অনেক প্রাপ্তিতে তাদের আনন্দ আর ধরে না। সব দেশে-বিদেশে তাদের আনন্দ প্রকাশের জন্য থাকে নানা উপায়। তবে উপায়হীন মানুষেরও অভাব নেই। এই উপায়হীন মানুষ হচ্ছে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ, যারা জীবন যাপনের হিসাব মেলাতেই উদ্বিগ্ন জীবন কাটিয়ে দেয়।
যারা সৎভাবে জীবন যাপন করতে চায়, তাদের কষ্টের শেষ নেই। যাদের অসৎ হওয়ার কোনো উপায় নেই, তাদেরও কষ্ট প্রবল। আর একধরনের সৎ শিল্পীরা সারা জীবনই কষ্টের জীবন যাপন করেন, যাঁরা শিল্পের কাজ করেন কিন্তু নিজেদের বিক্রি করতে পারেন না। আবার বিক্রি হলেও তাঁদের ভাগ্যে তেমন কিছু জোটে না।
বাংলাদেশ-ভারত উপমহাদেশে হাজার হাজার শিল্পী, হয়তো লাখ ঠেকবে, এমন একটা শিল্পের চর্চা করেন, যাঁদের মজবুত অর্থনীতি আছে, অথচ তাঁদের সেই নিয়মিত শিল্পের চর্চা থেকে কোনো অর্থ আসে না। তাঁদের অর্থনৈতিক জীবন আর কর্মজীবন আলাদা। সেই কর্মজীবনে তাঁরা শতভাগ নিবেদিত। কর্মজীবনে যে শিল্পচর্চাটা করেন, সেই অদ্ভুত শিল্পের নাম থিয়েটার। নিজেরাই ধারদেনা করে নাটক প্রযোজনায় অর্থলগ্নি করেন, টিকিটও বিক্রি হয়, কখনো শো হয় হাউসফুল। কিন্তু অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশকের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। কিন্তু হলমালিক টাকা পান। আলো সরবরাহকারী, পরিবহনব্যবস্থা, মেকআপম্যান, বিজ্ঞাপনের পত্রিকাও টাকা পায়। কিন্তু পান না শুধু সৃজনশীল কর্মীরা।
বাংলা রঙ্গালয়ের দেড় শ বছরের গোড়া থেকে বিষয়টি অবৈতনিক থাকলেও নাট্যদলগুলো খুব দ্রুতই পেশাদার হয়ে ওঠে। কোম্পানি এসে যায়, সেই কোম্পানি প্রায় ১০০বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে। এর মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার এসে গেছে—একটা সম্মিলিত উদ্যোগ। অদ্ভুত ব্যাপার, অর্থনীতির বিষয়টি আবেগের জোয়ারে ভেসে গেল। তারপর প্রায় ৭০ বছরের এই চেষ্টা চলছে—চাকরি, ছোটখাটো ব্যবসা, শিক্ষকতা করে মহৎ শিল্পচর্চা ভেবে থিয়েটারের কাজটি চলছে।
কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা একটা গুরুতর সংকটে পড়ে যাচ্ছে। তা ভেবে এর কোনো সমাধানের চেষ্টাও কেউ করছেন না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি উদাসীন। রাষ্ট্র যাঁরা চালান, তাঁদের কাছে এই শিল্প এতটাই অবহেলিত যে এই শিল্প ধ্বংস হলে তাঁরা বেঁচে যান। হয়তো তাঁরা ইতিহাসটাও জানেন না। কিন্তু এটা বোঝেন, বিরুদ্ধ পক্ষ এটাকে ব্যবহার করতে পারে। তার চেয়ে সংগীত ভালো, চারুকলা ভালো। কারণ এটা কেউ বুঝতে পারে না। কিন্তু নাটক? এত লোক একসঙ্গে গর্জে ওঠে, তাও আবার জীবন্ত দর্শকদের সামনে!
তবে ভারত সরকার থিয়েটারের এই শক্তিটাকে বুঝতে পারে বলে বেশ তোয়াজ করে চলে। কিন্তু যে লোকগুলো ঝামেলা করতে পারেন, ভারত সরকারও তাঁদের কখনো ছাড় দেয়নি। উৎপল দত্ত বারবার আক্রান্ত হয়েছেন; মুম্বাইয়ের বামপন্থী চলচ্চিত্রকারদেরও যে সমস্যা হয়েছিল। সমস্যাটা কী হলো? হাউসফুল একটি শোর পর সব খরচা বাদ দিয়ে কীই-বা থাকে?