জানুয়ারি মাসে প্রত্যাশিতভাবে সরকার সকল বিদ্যালয়ে নতুন বই বিতরণের উৎসব পরিচালনা করে, এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়; তবে সম্প্রতি সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে– প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বারবার শিক্ষা পাঠক্রম বা কারিকুলাম বদল প্রসঙ্গ।
সরকার থেকে সরকারে ইতিহাস নিয়ে মতপার্থক্যের কথা আমরা জানি; তাই ইতিহাস বই বদলে যায় সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু পুরো কারিকুলাম? পরীক্ষা পদ্ধতি? পাঠদান কৌশল?– সবই কেন বদল করতে হয়, তার যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। শিক্ষা কার্যক্রম যুগোপযোগী করার জন্যই কারিকুলাম পরিবর্তন সময়ের দাবি– সরকারি এই যুক্তির পেছনে নিশ্চিতভাবে যথার্থতা অনুপস্থিত।
আমাদের দেশে প্রচুর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ আছে, সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ৩০-৪০ বছরে কয়বার কারিকুলাম বদল হয়েছে? মূল কারিকুলামে, একবারও নয়। তাহলে বাংলা মাধ্যমে কেন এই নিরীক্ষার পর নিরীক্ষা? সময়ের সাথে আধুনিকায়ন, কেবল বাংলা মাধ্যমেই করতে হয় বলে, আমরা বলতে পারি, শিক্ষা পাঠক্রম বদল আমাদের উপনিবেশজাত মানসিকতার ধারাবাহিকতা।
আমরা পশ্চিমের দিকে মুখ করে আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কাঠামো সাজাতে চাই; কিছুদূর এগিয়ে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি নানা বিষয় দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়; আমরা খানিক এদিক খানিক ওদিক করে ‘নতুন’ নামে ‘আধখেঁচড়া’ কারিকুলাম চালু করে দিই। আবার কয়েক বছর পর সরকারের মনে হয়, বিদ্যালয়-উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠক্রম যথেষ্ট আধুনিক নয়। আবার তা বদলে ফেলা হয়।
যে কোনো কাজের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও গন্তব্য [অন্বিষ্ট] থাকে, এ দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কারিকুলামের পরিকল্পনা ও গন্তব্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তাই সরকার থেকে সরকারে তো বটেই, একই সরকারের কয়েক দফা সময়েই কারিকুলামের বদলের পর বদল হয়। প্রয়োজনের অস্থায়ী বিবেচনায় বদল করে দেওয়া হয়। এই মানসিকতা বাদ দিয়ে সকল অংশীজনের অংশগ্রহণে প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা পাঠক্রমের দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো নিশ্চিত করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে নিরীক্ষার ‘গিনিপিগ’ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা জরুরি।
২.
শিক্ষা পাঠক্রমের সাথে শিক্ষামাধ্যম নিয়েও আলোচনা আমাদের বারবার করতে হবে। বাংলাদেশে চার মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা চলছে– বাংলা, ইংরেজি, মাদ্রাসা ও ক্যাডেট কলেজ। এই চার মাধ্যমে কারিকুলাম যেমন ভিন্ন, তেমনই পাঠক্রমও আলাদা। একইভাবে আলাদা শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতনও। বাংলা মাধ্যমে প্রাথমিক স্কুলে ১০ থেকে ২০০ টাকা মাসিক বেতনে পড়া যাচ্ছে, আবার মানসম্পন্ন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের বেতন মাসিক ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। একই বয়সী শিশুদের স্কুলের মাসিক বেতনের পার্থক্যটি সমাজের বিপুল বৈষম্য যেমন প্রকাশ করে, তেমনই অনেক অসংগতির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়।