মামুন রশীদ প্রথিতযশা ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসনে। ২৫ বছরের অধিক সময় কাজ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে। ছিলেন সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় প্রধান নির্বাহী এবং বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কনিষ্ঠতম প্রধান। ব্যাংকিংসহ ব্যবসায় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াচ্ছেন প্রায় ৩০ বছরের অধিককাল। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়।
আপনি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের উত্থান ও বিকাশপর্ব একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন। বলা কি যায়, ব্যাংক খাত আস্থার জায়গায় সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে?
মামুন রশীদ: সবচেয়ে খারাপ কিনা জানি না, তবে আমরা ব্যর্থতা থেকে অনেক কম শিখি। ফলে আমরা ভুলে গিয়েছি বিসিসিআই ও ন্যাশনাল ক্রেডিট লিমিটেডের পতন। আমরা ভুলে গেছি পিপলস লিজিংয়ের পতন। গোপী গাইন ও বাঘা বাইনের গল্পের মতো এখানে তেল ও পানির মধ্যে পার্থক্য নেই। এ দেশে ভালো ও খারাপ ব্যাংকের মধ্যে কেউই পার্থক্য করে না। এটা আমানতকারীরা করেন না, নিয়ন্ত্রক সংস্থা করে না, সরকারের কর্তাব্যক্তিসহ কেউই আসলে করছে না। গ্রাহক হিসেবে সব সিদ্ধান্ত ব্যক্তির নিজেরই নেয়ার কথা, আর ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি উন্নত করার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদেরও কাজ হচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি শক্তিশালী করা। কিন্তু সিদ্ধান্তটি ব্যক্তির। আপনি টাকা পিপলস লিজিংসে রাখবেন না আইডিএলসিতে রাখবেন, তা আপনারই সিদ্ধান্ত। আপনি একটি সবল ব্যাংকে রাখবেন নাকি দুর্বল ব্যাংকে রাখবেন তার সিদ্ধান্তও একান্তই নিজের। পত্রিকারও দায়িত্ব আছে এখানে। শুধু বিজ্ঞাপন দিয়েছে বলে দুর্বল ব্যাংকের দুর্বলতা গোপন করব, এটা ঠিক না। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পতনের পেছনে তদারকি সংস্থারও দায় আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।
ব্যাংকের সংখ্যাও ব্যাংক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কিনা। এতগুলো ব্যাংক কি আসলেই আমাদের প্রয়োজন ছিল?
মামুন রশীদ: অবশ্যই, এর দায় আছে! এতগুলো ব্যাংক দরকার ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে সুইট ডিবেট হয়েছে। ব্যাংক সংখ্যা বাড়ানো দরকার কিনা, এ প্রশ্নে তারা বলেছিলেন, গ্রামে-গঞ্জে ব্যাংক সেবা পৌঁছে দিতে অনেক ব্যাংক দরকার। আমরা বলেছিলাম, আমাদের যে ব্যাংকগুলো রয়েছে সেগুলোরই শাখা বৃদ্ধি করছি না কেন? আমরা কৃষি ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংককেই তো প্রণোদিত করতে পারতাম! কৃষি ব্যাংক কেন ব্যর্থ হবে? কৃষি ব্যাংক থাকার পরও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের কি প্রয়োজন ছিল? তখন তারা বলেছিলেন, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক দরকার ছিল, কারণ বিদ্যমান ব্যাংক দিয়ে সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। আমরা বলেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের মতো নানা উপায়ে ব্যাংকিং সেবা মানুষের দোরগোরায় পৌঁছে দিতে পারতাম, শাখা ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন উপায়ে। এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে যে ধরনের ইনসাইডার লোন বা শ্যাডো লোন হয়েছে তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। ঠিকমতো খতিয়ে দেখলে দেখা যেত বেশির ভাগ মন্দ ঋণের পেছনে ব্যাংক মালিকরা জড়িত।
আপনি কৃষি ব্যাংকের কথা বলছিলেন। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঋণ পরিশোধে সবচেয়ে এগিয়ে কৃষকরা। কিন্তু কৃষি ব্যাংকই সবচেয়ে ব্যর্থদের কাতারে। এর কারণ কী হতে পারে?
মামুন রশীদ: কৃষি ব্যাংকের ব্যর্থতার পেছনে এর নেতৃত্বের দায় আছে বলে মনে করি। সরকারি ব্যাংকের একটি সাধারণ চরিত্র হচ্ছে, এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে না। কৃষি ব্যাংককে আরেকটি পূবালী ব্যাংক বানানোর চেষ্টা করেছিলেন প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। প্রাইভেট সেক্টরের চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের ঋণ দিতে গিয়ে তা বুমেরাং হয়েছিল। এতে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর মন্দ ঋণ হয়েছিল। উনার প্রতি আমাদের সম্মান আছে কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টুলস ব্যবহার করার কারণে উদ্যোগগুলো সফলতার মুখ দেখেনি। এতে একপর্যায়ে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি চলে গিয়েছিল। জনতা, রূপালী ও কৃষি ব্যাংকে একই উপায়ে মন্দ ঋণ হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যর্থতার পেছনে পরিচালকমণ্ডলীর দায়ভার অনেক বেশি।