৯ ডিসেম্বর ‘আজকের পত্রিকা’র একটি ছোট খবরে চোখ আটকে যায়। মনে পড়ে যায় রামের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’। সংক্ষেপে খবরটি হচ্ছে, নবনিযুক্ত আফগান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই এক সমাবর্তনে বলেছেন, ‘বর্তমান তালেবান সরকার দেশে-বিদেশে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার মূল কারণ মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া।’ তিনি আরও বলেছেন, শিক্ষা হচ্ছে প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। পুরুষ হোক আর নারী, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সবার অধিকার আছে শিক্ষা গ্রহণের। আসলেই একটি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীদের ঘরে আটকে রেখে বর্তমান বিশ্বের কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। দেরিতে হলেও তালেবানদের যে বোধোদয় হচ্ছে, সেটাই বড় কথা।
কিন্তু আমার প্রশ্ন, আফগানিস্তানের তালেবানরা বুঝতে পারলেও আমাদের দেশে তাদের যে ব্যাপক সমর্থকগোষ্ঠী আছে, তারা কি বুঝতে পারবে? দেশে যে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন মানুষের অভাব নেই, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের কোনো খবরে হাজার হাজার অশ্লীল কমেন্ট ও লাইক দেখলেই অনুমান করা যায়।
দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাদের পদচারণ বেশ প্রবল। এখনকার ফেসবুকের যুগে একটা খুব মজার ব্যাপার ঘটে। নিজের প্রোফাইলে অনেকে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে থাকলেও প্রগতিপন্থী কোনো খবর বা মৌলবাদী কোনো সংবাদে তাদের মন্তব্য দেখলেই ভেতরকার ‘প্রগতিশীলতা’ বেরিয়ে পড়ে! এটা শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই নয়, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের ক্ষেত্রেও তা-ই। এরকমই কিছু ছদ্মবেশী প্রগতিশীলকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল, যখন যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুসংবাদে একশ্রেণির সাংস্কৃতিক কর্মীদের ‘ওয়াল’ শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল।
যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম। আবার আফগানিস্তান প্রসঙ্গে আসি। যে আফগানিস্তান ষাট, সত্তর ও আশির দশকে নারী শিক্ষা ও প্রগতিশীলতার চর্চায় অনেক এগিয়ে ছিল, সেই আফগানিস্তানে এখন নারীশিক্ষা এবং প্রকাশ্যে তাদের চলাফেরা নিষিদ্ধ। মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকে মস্কোতে আমাদের সঙ্গে আফগান মেয়েদের দীপ্ত পদচারণ। জারগুনা বলে একটি মেয়ে আমাদের সঙ্গে মেডিকেলে পড়ত। তার চাচা ছিলেন আফগান প্রধানমন্ত্রী নূর মোহাম্মদ তারাকি। ওর হবু স্বামী ছিলেন আফগান বিমানবাহিনীর পাইলট।
তালেবানরা যখন সেই নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্ষমতায় এল, তখন জারগুনাসহ অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত আফগান দেশছাড়া হয়ে পাশ্চাত্যে আশ্রয় নেয়। ২০০১-এর ওয়ান-ইলেভেনের পর পাশার দান আবার উল্টে যায়। যে আমেরিকা ও পাকিস্তানের হাত ধরে সোভিয়েত খেদাওয়ের নামে আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান ঘটেছিল, সেই মার্কিনদের হাতেই তাদের সে যাত্রার পতন হয়েছিল। খোদ পাকিস্তানে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। প্রায় ২০ বছর মার্কিনদের প্রত্যক্ষ মদতে আফগানিস্তানে আবার নারীশিক্ষা ও আধুনিক জীবনযাত্রা চালু হয়। কিন্তু ২০২১ সালে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর তাসের ঘরের মতো আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন হলে আফগানিস্তান আবার নিকষ কালো অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে, নিষিদ্ধ হয় নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। আফগান সমাজের এই উল্টো যাত্রার প্রধান কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকার তাঁবেদার একটি ‘এলিট’ শ্রেণি আফগানিস্তান পরিচালনা করে। বলা বাহুল্য, তারা যথেচ্ছ লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার আত্মসাৎ করে। এদের সঙ্গে সাধারণ আফগান সমাজের কোনো যোগাযোগ বা মিথস্ক্রিয়া ছিল না। ফলে যা হয়, একটি শিকড়বিহীন শাসকশ্রেণি গড়ে ওঠে। আর সেই সুযোগটাই নেয় ধুরন্ধর তালেবানরা।
নব্বইয়ের দশকে তালেবানদের উত্থানে আমাদের দেশে স্লোগান উঠেছিল, ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। বলা বাহুল্য, ২০২১ সালে দ্বিতীয় তালেবান উত্থানে আমাদের এখানেও তালেবানি ভাবধারার লোকেরা উল্লসিত।