কয়েক দিন হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এস এম আবু বকরের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সময়ের ভাষায় বক্তব্যটি ‘ভাইরাল’ হয়েছে বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী অধ্যাপকদের এক সংবর্ধনা সভায় তিনি এই বক্তৃতা করছিলেন। তিনি বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই, সব হয়ে গেছে পরীক্ষার্থী।’ তিনি আরও বলছেন, ‘যদি শিক্ষাকে পূর্ণ করতে চান, তাহলে তার চিত্তের বিকাশ দরকার। সকাল থেকে বেলা আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত একটানা ক্লাস। কোনো বিরতি নেই।...যত সময় চিত্তের বিকাশ না হচ্ছে, তত সময় হল দখল চলবে; ঠেকাতে পারবেন না; কয়জনকে বহিষ্কার করবেন! সিট দখল চলবে; ডাইনিংয়ে খেয়ে পয়সা দেবে না, এগুলো মানুষ করার দায়িত্ব শিক্ষকের না!... ’
কথাগুলো ভাবাচ্ছে। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং প্রণিধানযোগ্য কথা। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় পরীক্ষা লেগেই থাকে! ভাইরাল বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা অনেক মন্তব্য থেকে এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। আর এই ‘পরীক্ষা’ একজন ছাত্রের জন্য রীতিমতো ভয়ানক দুর্ভোগ। তাঁর এই বক্তব্যে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন ছাত্র লিখেছেন, তিনি ২০২৩ সালে তিনটি সেমিস্টার ফাইনাল, বারোটি মিড টার্ম ও বারোটি ইনকোর্স পরীক্ষা দিয়েছেন। এর সঙ্গে তাঁর অ্যাসাইনমেন্টও ছিল। কী ভয়াবহ অবস্থা!
উপর্যুপরি পরীক্ষার ফলে ছাত্রদের শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক শ্রান্তি এসে যাওয়া স্বাভাবিক। এর ফলে তাঁদের চিন্তা করার সময় ও সুযোগ থাকছে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল চেহারা হতে পারে না। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ না থাকলে সেটা কোনো শিক্ষাই নয়। এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে কোনো কোনো শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না। অবশেষে তাঁর জমে যাওয়া একাধিক ক্লাস একটি ক্লাসে শেষ করে দেন। দুই সপ্তাহ বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা করে ডিপার্টমেন্টে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও অনেক শিক্ষকই তা পরিপালন না করে মাসের পর মাস ফেলে রাখেন। ফলে সময়মতো রেজাল্ট দেওয়া সম্ভব হয় না। আমরা এ-ও জানি, একটি সেমিস্টারের রেজাল্ট হয়নি অথচ পরের সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ফলে এমনও ঘটে, পরীক্ষায় খারাপ ফল করা ছাত্রটি ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ দেওয়ার সুযোগ পান না। রেজাল্ট কেন হয় না? কোনো না কোনো শিক্ষকের গাফিলতি; মূল কাজের চেয়ে অন্য কাজে মনোযোগ; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, শিক্ষক রাজনীতি, ব্যবসা, পদোন্নতি ইত্যাদি! এস এম আবু বকর এবং তাঁর মতো কিছু শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ছাত্রদের জীবন নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো অধিকার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে না। এটা রীতিমতো অপরাধ।
কিন্তু এগুলো হচ্ছে কেন? শিক্ষকের সচেতনতার অভাব, জবাবদিহির অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা, নাকি অন্য কিছু? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের আওতায় লিখিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার’র দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে শিক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা এ রকম—তাঁরা ছাত্রদের শিক্ষা দেবেন, গবেষণা পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন, ছাত্রদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ রেখে নির্দেশনা দেবেন ও ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস’ পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন। এখানে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়—শিক্ষকেরা শিক্ষা দেবেন (শুধু ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়নি) এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ রেখে পথনির্দেশ ও এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম দেখভাল করবেন। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের একাডেমিক কমিটির দায়িত্বের মধ্যেও কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের কথা বলা হয়েছে (এখানে এক্সট্রা না বলে কো-বলা হয়েছে)। প্রফেসর আবু বকর যে চিত্তের বিকাশের কথা বলেছেন, বোধ করি তিনি এই এক্সট্রা-কারিকুলার এবং কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের দিকেই বিশেষভাবে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ঘুরলে দুটো জিনিস সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। একটা হলো পোস্টার-ব্যানারসহ রাজনৈতিক সক্রিয়তা, আরেকটি হলো বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি। আমি দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা শুরু করেন; কোচিং শুরু করেন। তাহলে তিনি কি আর শিক্ষার্থী থাকেন! তিনি হয়ে যান পরীক্ষার্থী। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি রিপোর্ট পড়ছিলাম। সেখানে দেখলাম, লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার জন্য ভোররাত থেকে লাইন পড়ে যায়। ৮টায় লাইব্রেরি খুলবে। ছেলেমেয়েদের লাইন ধরে লাইব্রেরিতে যাওয়ার ভিড়। কিন্তু শিক্ষার্থী হিসেবে শিখতে নয়; বিসিএস পরীক্ষার পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিতে। এই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার চিত্র হয়, তাহলে ছাত্ররা শিখবেন কখন। কীভাবেই বা শিখবেন। আমরা বিশ্বমানব হওয়ার প্রতিযোগিতায় দাঁড়াব কী করে?