মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য বলতে উঠে আসত জনসংখ্যার ঘনত্ব, চরম দারিদ্র্য ও দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও অবকাঠামো বিনির্মাণ ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল ভারত থেকে ফিরে আসা ৮-১০ মিলিয়ন মানুষের পুনর্বাসন, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার দোসরদের অত্যাচার ও নির্যাতন এড়াতে শরণার্থী হয়েছিল।
১৯৭০-এর নভেম্বরে এ অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এতে আড়াই লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারায়। নতুন দেশটিকে এ ঘূর্ণিঝড় থেকে পুনরুদ্ধারের বিশাল কাজও করতে হচ্ছিল। ছিল খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রীর তীব্র সংকট। অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক, প্রশাসক, প্রকৌশলী বা প্রযুক্তিবিদ ছিলেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। ঠিক সে সময়ে অপর্যাপ্ত সরবরাহ এবং সিন্থেটিক শিল্পের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে দেশের অন্যতম অর্থকরী ও রফতানি পণ্য পাটের বৈশ্বিক বাজারও মন্দা। যৎসামান্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া কোনো শিল্পের অস্তিত্বই ছিল না। উপরন্তু সড়ক ও রেলপথসহ পুরো অবকাঠামো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছিল।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শিল্প মালিকরা তাদের কল-কারখানা ফেলে চলে গেলে বাংলাদেশ সরকারের হাতে পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকদের প্রায় ৩০০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এসে পড়ে, যা ছিল দেশের মোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯০ শতাংশ। সরকার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলো দেখভালের জন্য পাবলিক করপোরেশনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। তখন শিল্পের পুনর্বাসন ও উন্নয়নের পথনকশা প্রণয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশনই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এ কমিশনের সুপারিশে সরকার পাঁচ বছরের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে স্বাধীনতার এক বছর বিরতির পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ’৭৩-জুন ’৭৮) গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে এর ওপর ভিত্তি করে একটি দ্বিবার্ষিক (১৯৭৯-৮০) পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। এরপর এক বছর এমনিতে কাটিয়ে দিয়ে আগের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮১-৮৫) এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০) গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে চতুর্থ (১৯৯০-৯৫), পঞ্চম (১৯৯৭-২০০২), এর মাঝে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫) বাস্তবায়ন হয়। সপ্তম (২০১৬-২০) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ব্যাপক উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার কমিয়ে আনা, বৈদেশিক রফতানি বৃদ্ধি এবং দেশজ সঞ্চয়, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। এ উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর অর্জন অতীতের তুলনায় ভালো।
গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের এক অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সব মানদণ্ড পূরণ করেছে। ২০২০ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬৮ দশমিক ৩১ মিলিয়নেরও বেশি এবং মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ছিল ১ হাজার ৯৪০ ডলার (২০১৯)। মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫তম।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উভয় ক্ষেত্রেই মিশ্র উন্নয়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার একটি ভিত্তি সূচিত হয়। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে শুরু করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৯৯০-এর দশকে গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ দাঁড়ায়, যা আগের দশকে অর্জিত প্রবৃদ্ধির (৩ দশমিক ৮ শতাংশ) ১ শতাংশের বেশি। এত চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০০৭-০৮ পর্যন্ত বহু বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গড় মাথাপিছু আয়ের থেকেও কম ছিল।