‘একাত্তর সাল পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সে একাত্তরের কথা বলার চিন্তা যখন করি, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা প্রবল আতঙ্কস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, একটা মহান পবিত্র ভীতি সর্বসত্তা গ্রাস করে ফেলে। আমার মনে হয় একাত্তর সম্পর্কে কোন কিছু আমি কস্মিনকালেও ভুলতে পারব না।’
–আহমদ ছফা (২০২৩: ৭১)
১৯৭১ সালে– প্রায় পুরোটা বছর ধরিয়াই বাংলাদেশে গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়াছে। পুরোটা মানে মাত্র মার্চ হইতে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়। পরের বছর ৩০ জানুয়ারি নাগাদ সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধানকেও এই বছরের মধ্যে গণ্য করা যায়।
শেষ পর্যন্ত ১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ মর্যাদার স্বীকৃতি পাইয়াছে। কেন ১৪ ডিসেম্বর? অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর স্মৃতিকথায় এই জিজ্ঞাসার একটা উত্তর পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেন, ১১ কি ১২ ডিসেম্বর তিনি হঠাৎ মুনীর চৌধুরীর ফোন পাইলেন। তাঁহার জবানবন্দি অনুসারে, মুনীর বলিলেন: ‘শুনছেন, রাও ফরমান আলী নাকি মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, পাক সৈন্যদের বাংলাদেশ ত্যাগ করার ব্যবস্থা করে দিলে ওরা নাকি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যাবে। তা হলে তো স্বাধীনতা দোরগোড়ায়। তাই না?’
কবীর চৌধুরী তারপর যোগ করিতেছেন: ‘ফোনে গলা শুনেছি, চোখে দেখিনি। কিন্তু কল্পনায় দেখেছিলাম, আজও দেখি, সে চোখে সেদিন আলো জ্বলে উঠেছিলো। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর, স্বাধীনতার কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র, সে আলো চিরদিনের জন্য নির্বাপিত করে দিলো বর্বর পশুশক্তি।’ (স্মারকগ্রন্থ, ১৯৯৪: ৮)
কবি মেহেরুন্নেসা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো খ্যাতিমান ছিলেন না। জীবিতাবস্থায় তাঁহার কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় নাই। তাঁহার সম্পর্কে বাংলা একাডেমির ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ নামক প্রকাশনায় ১৯৮৪ সালে ছাপা, ১৯৯৪ সালে পুনর্মুদ্রিত– লেখা হইয়াছিল: ‘[তিনি] পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকার মীরপুরে বসবাস করেন। স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। মা, বড় বোন এবং নিজের চেষ্টায় জ্ঞান অর্জন তাঁর কৃতিত্ব। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রুফ দেখতেন এবং ফিলিপ্স কোম্পানিতে চাকুরি করতেন।’ (স্মারকগ্রন্থ ১৯৯৪: ৪৯)