অবরুদ্ধ ঢাকা ছিল যেন এক মৃত্যুপুরী

জাগো নিউজ ২৪ শাহানা হুদা রঞ্জনা প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:০৬

২৫ মার্চের কালরাতের পর থেকে আমাদের পাড়াটা ক্রমশ খালি হয়ে যেতে থাকলো। প্রতিদিন একজন, দুজন করে বাড়িঘর ছেড়ে কাপড়ের পুটলি নিয়ে বা একটা ট্রাংক-বেডিং নিয়ে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছিল। আমার বন্ধুরা সব একে এক চলে যাচ্ছিল। কে, কোথায়, কেন যাচ্ছিল সেটা তখন না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছিলাম সবার চোখে ভয়, আতংক। আমাদের বাড়িওয়ালা খালাম্মা রাতের আঁধারে, চুলায় ভাত বসিয়ে আম্মাকে এসে বললেন, ‘আমরা চলে যাচ্ছি কুমিল্লায়। তোমরা চাবিটা রাখো। আমার মেয়ে বড়, চারটা ছেলে এদের নিয়ে থাকা ঠিক হবে না।’ কে নাকি এসে বলেছে সকালে পাড়ায় মিলিটারি আসবে। খালুও আব্বাকে ফিস ফিস করে কি যেন বলে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন।


আমার খুব কষ্ট হলো বিউটি আপার জন্য। বিউটি আপা তেঁতুল ও কাঁঠালের মুচি দিয়ে খুব মজার ভর্তা মাখতে পারতেন। আমার চুল বেঁধে দিতেন, গল্প শোনাতেন, ভাতও খাইয়ে দিতেন। সেসময় প্রতিবেশীরা ছিল আত্মার আত্মীয়। সবার সঙ্গে সবার পরিচয়, অন্তরঙ্গতা ছিল আত্মীয়র চাইতেও বেশি। স্বাধীনতার পর আর কখনো বিউটি আপাদের সাথে দেখা হয়নি। কারণ যুদ্ধ চলাকালেই এই ফাঁকা ভূতের গলি থেকে আমরা পাশে আরেকটি পাড়ায় চলে গিয়েছিলাম, যেখানে অন্তত কিছু পরিবার তখনো ছিল।


প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইংরেজ আমলে মিস্টার বুথ নামে এক সাহেব থাকতেন এলাকাটিতে। তিনি ছিলেন ওখানকার প্রথম সাহেব বাসিন্দা। সেজন্য তার নাম অনুসারে রাস্তাটার নাম দেওয়া হয়েছিল, বুথের গলি। সেই বুথের গলি কবে যে লোকমুখে ভূতের গলি হয়ে গেলো কেউ বলতে পারবে না। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাড়াটি সত্যিই যেন ভূতেরই গলি হয়ে গিয়েছিল।


এভাবে পাড়া পুরো খালি হলো, শুধু আমরা তিন-চারটি পরিবার ঘর আটকে পড়ে রইলাম। আমি তখন খুব ছোট ৬ বছর বয়স। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না আমাদের। কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম টুংটাং বেল বাজানো বেবি আইসক্রিমওয়ালা আর আসছে না।


প্রতি সপ্তাহে পাড়ায় একটা ভাল্লুকওয়ালা আসতো খেলা দেখাতে, একটা বাঁদরনাচওয়ালা ও একজন সাপুড়েও বাঁশি বাজিয়ে খেলা দেখাতো। কিন্তু পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যাওয়ায় সবাই কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। বাতাসে চিরচেনা আনন্দ মুছে গিয়ে শুধু গুমোট একটা অনুভূতি অনুভব করছিলাম। ছোট হলেও বুঝতে পারছিলাম কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।


দেশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, মানুষের দুঃখ, কষ্ট কী এবং কেন হচ্ছে তাও জানতাম না। শুধু লক্ষ্য করতাম সন্ধ্যা নামার পরপরই কেমন যেন একটা সুনসান নীরবতা চারদিকে। আব্বাসহ পাড়ার মুরব্বিরা ফিসফিস করে কথা বলতেন। আব্বা সাংবাদিক ছিলেন বলে সবাই আব্বার কাছে এসে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইতেন। মাঝে মাঝে আব্বারা সবাই মিলে শরীফ চাচা ও জাহানারা চাচি (জাহানারা ইমামের) বাসায় যেতেন বিস্তারিত আলোচনার জন্য। মনে আছে সকাল-সন্ধ্যায় শুধু বিবিসি শুনতো সবাই।


তবে আমি সেই বয়সে এসব ঘটনার খুব একটা গুরুত্ব বুঝতাম না, বোঝার কথাও না। শিশুর মনোজগৎ নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখলাম, শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো কোনো প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘটনা, যা মনে দাগ কেটে যায়, তা শিশুরা মনে রাখতে পারে। হয়তো মুক্তিযুদ্ধ আমাকে ততটাই পরিণত করে তুলেছিল, যে জন্য এখনও অনেক ঘটনা আমার কাছে জীবন্ত।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us