এটি সর্বজনবিদিত যে, ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচিত হয়েছিল দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে। মহাকালের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।
সব ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, সৎ ও সুদূরপ্রসারী নেতৃত্ব বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-নিষ্পেষণ কালক্রমে বাঙালি জাতিকে করেছে নির্বিশঙ্ক। তারা ত্যাগের ভয়কে করেছে জয় এবং শত্রুকে পরাজিত করে এগিয়ে নিয়ে গেছে স্বাধীনতার শিখা অনির্বাণ। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, স্বাধীন মাতৃভূমি ছাড়া বাঙালির আর্থ-সামাজিক মুক্তি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তৎকালীন ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামের একটি অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এর শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতির ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতিকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ছাপ্পান্ন সালে সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা, উনসত্তরের রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ইত্যাদি ঘটনা জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছিল।
এর আগে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে এ অঞ্চলের নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’।
১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ উত্থাপিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের জনতার বিক্ষোভ গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতা তাদের প্রাণপ্রিয় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে সংবর্ধিত করেন এবং তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সব নির্বাচিত সদস্যের ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য থাকার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাপঞ্জিতে পরিপূর্ণ। ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের উভয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।