ডিসেম্বর আমাদের একটি আনন্দের মাস, আন্দোলন-সংগ্রামের মাস এবং সর্বোপরি বিজয়ের মাস। ছোটবেলায় আমাদের ফাইনাল পরীক্ষাটা হতো ডিসেম্বর মাসে, তারপর মুক্তি। ডিসেম্বরের প্রায় অর্ধ মাসের পরে জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হতো। সেটিও আনন্দের।
প্রমোশন পেয়ে আমাদের হাতে আসত নতুন বই। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে আমাদের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো। আমরা অপেক্ষা করতাম পরবর্তী ডিসেম্বরের জন্য। এই সময়ে বাংলার ফসলের মাঠে নতুন ধানের গন্ধে শুরু হতো পিঠা-পুলির আয়োজন। নানা ধরনের লোকসংগীতের সময় ছিল এটা। যাত্রা পালাগান, কবিগান, উত্তরবঙ্গের পালাটিয়া, ভাওয়াইয়া এসব গানের সুর পথে-প্রান্তরে ভাসতে থাকত।
আমাদের আন্দোলনের মাসও ছিল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। সেভাবেই আমাদের জীবনে এসেছিল ১৬ ডিসেম্বর। নয় মাসের যুদ্ধের পর এক রক্তাক্ত বিজয়। একদিকে আকাশে-বাতাসে সর্বত্র বিজয়ের ধ্বনি আর অন্যদিকে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। এই সবকিছুর পরেই আমাদের জীবনে এল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যে স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং কোনো বিদেশি শাসন নয়, একেবারেই বাঙালির নিজস্ব শাসনের রাষ্ট্র। বাঙালি কোনো দিন স্বাধীন ছিল না। সুদূর অতীত থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত বাঙালিরা বিদেশি শাসিত। সর্বশেষ শাসন পাঞ্জাবির। আমরা দীর্ঘদিন লড়াই করেছি, বিদেশি শাসকদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও আমাদের কৃষক ন্যূনতম অর্থ পেতেন, যা দিয়ে শুধু বেঁচে থাকা যেত।
পলাশীর এক ইংরেজ সৈনিকের চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, এই অঞ্চল অত্যন্ত সুফলা, বঙ্গের গরিব মানুষেরাও দুবেলা খেতে পায় এবং এতেই তারা সুখী। তারা পরিশ্রমী এবং খাবারের অতিরিক্ত তেমন কোনো চাহিদা নেই। সেই সৈনিক সে সময়ের শাসনব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, সুশাসন ও স্বাধীনতার অনুপস্থিতি এ দেশের মানুষকে আয়েশে দিন কাটাতে দেয়নি। প্রাচ্য শাসকদের মনোভাব হচ্ছে প্রজাদের গোলাম করে রাখা। অতিরিক্ত শাসন নিয়ন্ত্রণের ফলে প্রজাকুল নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হতো।
ষাটের দশকে আমরা সাধারণ মানুষের নিদারুণ কষ্ট দেখেছি; বিশেষ করে কৃষকদের। আমাদের পাট সারা বিশ্বে রপ্তানি হতো। বিপুল অর্থ আসত বিদেশ থেকে। কিন্তু সেই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর আমাদের কোনো হাত ছিল না। কাগজ উৎপাদন করেও বাংলার মানুষকে উচ্চমূল্যেই কাগজ কিনতে হতো। এটা ছিল একটি নয়া ঔপনিবেশিক অবস্থা। এসব অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও করা হয়েছিল; কিন্তু তখন সুশাসনের অভাবে এগুলো কার্যকর হতে পারেনি।