ভেবেছিলাম সমাজ বিনির্মাণে রাজনীতি নিয়ে লিখব। পরে মনে হলো বিনির্মাণ কেন? নির্মাণের আগে যে ‘বি’ উপসর্গটি যুক্ত, তা ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচকতা বলে আসলে কিছুই আর নেই, সেই সমাজে ‘সমাজ বিনির্মাণে রাজনীতি’ এই শিরোনাম কি যুক্তিযুক্ত? তার চেয়ে রাজনীতি সমাজ নির্মাণে কী ভূমিকা রাখছে তার আলোচনা জরুরি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ভাগ্যবান এই কারণে যে আমি বাংলাদেশের জন্ম দেখেছি। জন্মসূত্রে পরাধীন দেশের নাগরিক ছিলাম আমি।মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশের স্বাধীনতায় নিজেকে স্বাধীন হতে দেখেছি। শরণার্থী কী বা কাকে বলে, সেটাও জানা আছে আমার। একাত্তরে আমার বয়স কম হলেও বুদ্ধি খোলার বয়স হয়ে গিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলও দেখেছি আমি। বাহাত্তরে যে দেশটি স্বপ্ন আর আদর্শ নিয়ে সামনে যাবে বলে চিন্তা করেছিল তার পেছনে যাওয়ার শুরুটা দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। দুর্ভাগ্য এই, তিয়াত্তর সালে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র ইউনিয়নকর্মী মাহবুব পরাগের হত্যাকাণ্ড ছিল কিশোরবেলার চরম বিস্ময়! সে বিস্ময় কাটতে না কাটতেই বাকশাল, এরপর বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার রাতটিই মূলত টার্নিং পয়েন্ট।
যার সর্বশেষ পরিণতি পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরে জেল হত্যাকাণ্ড। দুনিয়ার ইতিহাসে এমন জঘন্য অমানবিক হত্যাকাণ্ড খুব বেশি দেখা যায় না। সে রাতেই মূলত আদর্শিক রাজনীতির কবর খোঁড়া হয়েছিল। এরপর কালো অধ্যায়ের রাজনীতি ছিল জিয়ার সামরিক শাসন আর দালালদের ফিরে আসার অপ ইতিহাস। সেই ধারাবাহিকতায় একনায়ক এরশাদ; অতঃপর যা যা ঘটনা তা আমাদের কারও অজানা কিছু নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি অতীত নিয়েই থাকব? নাকি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এবং ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা কয়েক প্রজন্মের কথা ভাবব? যেকোনো জাতি তার ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করে না। একমাত্র আমরাই ভবিষ্যৎ ভাবার বদলে অতীত নিয়ে মেতে থাকি। দেশের দিকে তাকালে প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের মনে যে বেদনা জাগে তা-ও অকপটে বলা যায় না। বন্ধুরাও মনে করে বিদেশে আরামে বসবাস করা মানুষের এসব বলার অধিকার নেই। আসলে কি তাই? যাঁরা দেশের রেমিট্যান্সে অবদান রেখে দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করেন, তাঁদের বলার অধিকার থাকবে না? না থাকলে দেশের বাইরে অবস্থানরত নেতাদেরও তো বলার অধিকার থাকে না। থাক সে কথা।
সমাজ নির্মাণে রাজনীতি কথাটা উঠছে এই কারণে যে, এখন দেশে আসলে কোনো রাজনীতি নেই। শুধু দেশে না, পৃথিবীর কোনো দেশেই আগের মতো রাজনীতি নেই। না থাকার বাহ্যিক কারণ ‘প্রযুক্তি’। ডিজিটাল মিডিয়া, বিশেষ করে হাতে হাতে মোবাইল আসার পর তরুণ সমাজ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটা দুনিয়াময় সত্য। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে লাভ হবে না।
যেসব দেশ বা সমাজে গণতন্ত্র আসন পেতেছে, সেখানে নির্বাচনে নিশ্চিন্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা যায়। তবে তাদের আর আমাদের বাস্তবতা এক নয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্র আসলে সোনার হরিণ। যাঁরা যখন বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরাই গণতন্ত্র চাই বলে সমাজে আওয়াজ তোলেন।