খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ৩৫-৪০ বছর আগেও মালয়েশিয়া, ইরান, ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় (তখন অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ছিল না) ও মেডিকেল কলেজে পড়তে আসত। এখন আসে না? হ্যাঁ, দু-একটি দেশ থেকে আসে। আগে তো আশপাশের দেশগুলো অপেক্ষা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান ভালো ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো এক সময় চতুর্দিকে শিক্ষার আলো ছড়াত। তাহলে এখন কি আমাদের লেখাপড়ার মান কমে যাচ্ছে? নাকি অন্যরা আরও বেশি গতিতে আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে? আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান হয়তো কমে যায়নি, কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়-ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় শিক্ষার মান আমাদের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ওরা আর আমাদের দেশে আসে না। এই তো কয়েকদিন আগে QS World University Ranking Asia 2024-এর তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রথম একশ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ভারতের ৭টি, পাকিস্তানের ২টি, ইরানের ২টি, ইন্দোনেশিয়ার ৪টি এবং মালয়েশিয়ার ৯টি প্রতিষ্ঠান আছে। অর্থাৎ মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাবিচারে মালয়েশিয়ার ভারতের চেয়েও এগিয়ে।
QS World University Ranking Asia 2024-এর তালিকা প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন আগে Times Higher Education পৃথিবীর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ যে র্যাংকিং প্রকাশ করেছে, তার প্রথম ১ হাজারটির মধ্যে বাংলাদেশের ব্র্যাক, ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নাম রয়েছে। ৮০০ থেকে ১ হাজার ক্রমের মধ্যে অবস্থান করা; উপরের চারটি প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই অবশ্য সুনির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত হয়নি। উপরোক্ত জরিপ পরিচালনাকারী Times Higher Education (পূর্বনাম The Times Higher Education Supplement) লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক একটি ম্যাগাজিন। এটি বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণা ও রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে।
আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছি। আমাদের উন্নয়নের সূচকগুলো ক্রম ঊর্ধ্বমুখী। মহাকাশেও আমাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছি। আমাদেরও দুই, চার, পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নেবে, বিশ্বের সবাই ওসব প্রতিষ্ঠানের নাম জানবে, এ প্রত্যাশা তো আমরা করতেই পারি। যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত-বহু পুরোনো ও নির্ভেজাল একটি কথা। আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার ৭২.৯। স্কুলে শিক্ষার্থীর এনরোলমেন্ট বেড়েছে। নারী শিক্ষায় অগ্রগতি এসেছে। দিন দিন স্কুল-কলেজ, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেড়ে চলেছে। কিন্তু যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, সেগুলো শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। সেজন্য কোয়ালিটি এডুকেশনের চিত্র হয়তো খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। উদ্ভাবনী কার্যক্রমেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে, আমাদের মৌলিক গবেষণা ধর্তব্যে আসে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো মেধাবী ব্যক্তির অসাধারণ কৃতিত্বের বিপরীতে আমাদের সমষ্টিগত উৎকর্ষ এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হয়নি। তাই হাজার বছরের সভ্যতার আমাদের এ জনপদের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওপরের তালিকায় গর্ব করার মতো কোনো স্থান অধিকার করতে পারেনি। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতের হার বহু উন্নত দেশ অপেক্ষা অনেক বেশি। অথচ জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে ওসব দেশ কত এগিয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি ১০৩টি মেডিকেল কলেজসমৃদ্ধ আমাদের দেশের মানুষকে চিকিৎসার জন্য ২৩টি মেডিকেল কলেজের দেশ থাইল্যান্ড গমন ঠেকানো যায়নি। এর জন্য কি এককভাবে কোনো কারণ দায়ী? নাকি বহুবিধ কারণের সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মনোযোগ’ ও ‘অগ্রাধিকারে’র জায়গাটিকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারার জন্য এ পিছিয়ে পড়া।