একটি ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করছি। ১৯৯৩ সালে সুদানে দুর্ভিক্ষের সময় এক শিশুর ছবি তুলেছিলেন বিশ্বখ্যাত আলোক চিত্রশিল্পী কেভিন কার্টার। দুর্ভিক্ষে খেতে না পেয়ে হাড্ডিচর্মসার একটি শিশু মাটিতে পড়ে আছে, মৃত্যুর অপেক্ষায়। আর তার অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে একটি শকুন, খাদ্যের অপেক্ষায়। শিশুটি মুমূর্ষু, কোনো শক্তি নেই। শকুনটি ধীরস্থির, কোনো তাড়া নেই। শিশুটির মৃত্যু হলে, শকুনের খাবার হবে...! ছবিটি ১৯৯৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়। ১৯৯৪ সালে জিতে নেয় পুলিৎজার পুরস্কার। কিন্তু ভয়াবহ বিতর্ক তৈরি হয় ছবিটি নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে, সেদিন ছবি না তুলে শিশুটিকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টা কেভিন করেছিলেন কিনা? এক সময় কেভিন নিজেও নিজেকে এই প্রশ্ন করা শুরু করেন। নিজেকে অপরাধী মনে করে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণায় নিমজ্জিত হয়ে ১৯৯৪ সালেই আত্মহত্যা করেন তিনি। যদিও নিয়ং কিং নামের শিশুটি মারা গিয়েছিল আরও পরে, ২০০৭ সালে।
ক্ষুধার জ্বালা আসলে বড় জ্বালা। কিন্তু সবাইকে তো আর এই যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয় না। তাই সমাজের একদিকে যখন খাবারের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে পাকস্থলী উপচে খাবার আঁস্তাকুড়ে ফেলার নিদর্শনও কম নয়। খাদ্যের এমন অপচয় আজ এক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাকে খাদ্যের অপচয় বলব? সাধারণ অর্থে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার নিয়ে তা খেতে না পেরে ফেলে দেওয়াকেই অপচয় বলা যায়। কিন্তু বড় পরিসরে চিন্তা করলে দেখব, খাদ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার প্লেটে যাওয়া পর্যন্ত যেকোনো স্তরে, যদি তা আর খাবার যোগ্য না থাকে, সেটাও আসলে অপচয়।
ব্যক্তি পর্যায়ে খাবার অপচয়ের সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ বিভিন্ন দাওয়াত বা অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য প্লেটে নেওয়া, আত্মীয়-স্বজন বা অনেকে জোর করে বেশি খাবার প্লেটে দেওয়া, পরে অল্প খেয়ে বা খেতে না পেরে বাকিগুলো রেখে দেওয়া, যার স্থান হয় ডাস্টবিনে। বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পারিবারিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, উৎসব, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্স, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বড় বড় রেস্টুরেন্ট হোটেলে দেখা যায় প্রত্যেকের প্লেটে খাবারের পাহাড়। সেই এভারেস্ট জয় করে সে সাধ্য কার! তাই এর সিংহভাগেরই গন্তব্য হয় ভাগাড়ে। অপরিকল্পিত খাবার ব্যবস্থাপনায় প্রচুর খাবার অপচয় হয়। রান্না করা হয় প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য।
একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। খাবার টেবিলে আমার পাশে এক ভদ্রলোক তার ৮-১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে বসেছেন। ছেলেটি ছোট বলে বেয়ারা তার প্লেটে খাবার একটু কম দেওয়ায় ভদ্রলোক রেগেই গেলেন। বেয়ারাকে রাগতস্বরে আরও খাবার দেওয়ার আদেশ করলেন। এরপর নিজেই বাটি হাতে নিয়ে মাংস আর তরকারি ছেলের প্লেটে ঢেলে দিলেন। বাচ্চা ছেলে সাধ্যমতো খেলো। খাওয়া শেষে তারা হাত ধুতে উঠে গেলেন। ছেলেটার প্লেটে তখনো যে খাবার পড়ে রয়েছে তাতে আরেকজনের খাওয়া হয়ে যাবে, অথচ তা গেল ডাস্টবিনে।