মঙ্গলবার রাত প্রায় ১২টা। নক্ষত্রের চোখে ঘুম। অনেক কষ্টে জেগে রয়েছে সে– বাবা বাড়ি ফিরবে। মা নীলার কোলে মাথা রেখে আধো ঘুম, আধো জাগরণে বাবার না ফেরার দেশে চলে যাবার খবর শুনতে হয়েছিল এই শিশুকে। এমনই হয়তো ছিল তরুণ সংগঠক, প্রকাশক আরিফুল ইসলামের বাড়ির ছবিটি।
বন্ধু সৌভিক করিমকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে নিউ ইস্কাটন এলাকায় ঘাতক ট্রাকের আঘাতে প্রাণ হারান আরিফুল। সড়ক দুর্ঘটনার এমন মর্মান্তিক ইতিহাস নতুন নয়। আরিফুলের আগে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। কেউ ‘মুক্তির গান’-এর তারেক মাসুদের মতো নামি মানুষ, কেউ সাধারণ মধ্যবিত্ত নগরবাসী, কেউবা প্রান্তিক চাষি। প্রতি মাসে এখন পাঁচ শতাধিক মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশের রাজপথে! বছরে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজারে। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান তেমনটিই বলছে। এই ভয়াল মৃত্যুফাঁদ থেকে কি কোনো মুক্তি নেই আমাদের? এই দুর্ভাগ্য কি কেবল বাংলার মানুষের, না বিশ্বের অন্যত্র এমন দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়?
সড়কে নিরাপত্তা আনতে হলে নিশ্চিত করতে হবে–আমাদের রাজপথ নিরাপদ, যানবাহনগুলো মানসম্পন্ন, সর্বোপরি আইন কেবল ফাঁপা বুলি নয়, তা বাস্তবায়িত হয় সব সময়ে, সবখানে। ধরা যাক, আমাদের সড়ককে আদর্শ হিসেবে খুঁজে পেয়েছি ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে উত্তম সড়ক ব্যবস্থাপনার কী কী বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়বে? জাতিসংঘের এসকেপ কী বলছে? তাদের মতে, উত্তম সড়ক নিরাপত্তায় জরুরি সড়কের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিবেদিত ও পূর্ণভাবে অর্থায়িত একটি সংস্থা দরকার। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হ্রাসের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা এবং ঝুঁকি হ্রাসকল্পে আইন গঠন ও তার যথাযথ প্রয়োগ। এসকেপের মতে, এ আইনগুলো হচ্ছে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোয় নিষেধাজ্ঞা, মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেটের ব্যবহার, গাড়িতে সিটবেল্ট ব্যবহার, শিশুদের জন্য বিশেষ সিট ও সিটবেল্ট ব্যবহার, মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এবং মাদকদ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালানোতে নিষেধাজ্ঞা। এসকেপের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুসারে এ ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের বর্তমান স্থিতি আশঙ্কাজনক। তারা বলছে, বাংলাদেশে কোনো সড়ক-ঝুঁকি নিরসনে নিবেদিত ও পূর্ণ-অর্থায়িত সংস্থা নেই। দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমানোর লক্ষ্য ৫০ ভাগ। অর্থাৎ জিরো ডেথ টলারেন্স এ দেশে নেই। সড়ক আইন রয়েছে চারটি। তবে সিটবেল্ট, শিশু নিরাপত্তা আর মোবাইল ফোনে নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত আইন নেই।
তবে এসকেপ বলছে যে, একটি আইনেরও যথাযথ প্রয়োগ নেই বাংলাদেশে। আরেকটি বিষয়েও এই রিপোর্ট আশঙ্কাজনক। তা হলো যানবাহনের নিরাপত্তার মান। নিরাপদ যানবাহনের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য– সিটবেল্ট, সম্মুখ সংঘর্ষ প্রতিরোধক, পার্শ্ব সংঘর্ষ প্রতিরোধক, ইলেকট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল, শিশু নিরাপত্তা, মোটরসাইকেলে অ্যান্টি-লক ব্রেক সিস্টেম থাকা। এর একটিও লক্ষণীয় নয় বাংলাদেশে। যে দেশগুলোতে সড়ক-ঝুঁকির জন্য নিবেদিত সংস্থা রয়েছে, আইন রয়েছে এবং প্রয়োগ, যানবাহন নিরাপদ; সেই দেশে সড়কে মৃত্যু তত কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।