আমার এক সময়ের এক সহকর্মী মারা গেলেন মাসখানেক আগে, রাতে, পুলিশ হেফাজতে। রাত এগারোটায় নিয়ে গেছে থানায়, রাত বারোটায় দম শেষ। এক ঘণ্টাতেই জীবনেরও বারোটা বেজে কাবার তার। গণমাধ্যম, জনমাধ্যমে (যাকে সোশ্যাল মিডিয়া বলে) অক্টোবরের ৪ তারিখে খবরটা প্রথম দেখে (ধীরে ধীরে ভেতরের অনেক খবরই বেরিয়েছে পরে) ভীষণ আঘাত পেলাম। কী এমন গুরুতর অপরাধটা করলেন তিনি, অবসরের ছয়টা বছর পেরিয়ে! চাকরিকালে ছিলেন তো একেবারে নির্বিবাদী, শান্ত-শিষ্ট, স্মিত মুখ, চাকরিনিষ্ঠ।
ঘনিষ্ঠ না হলেও পরিচিত তো বটে, রাষ্ট্রীয় এক দপ্তরে (দুদকে) একসঙ্গে বছরকয়েক চাকরির সুবাদে। আমি ছিলাম ডেপুটেশনে, তিনি ছিলেন সেই দপ্তরের খাস একেবারে। বয়সে আমার চেয়ে বছরখানেকের বড়, পদে আমার চেয়ে কয়েক ধাপ নিচে। ডেপুটেশনের চোটে খাসদের পদোন্নতি জোটে না প্রায় এ-দপ্তরে। জ্যেষ্ঠতা তালিকায় ও পদোন্নতি কমিটির সুপারিশে সবার আগে তার নামটা থাকা সত্ত্বেও অনেক পেছনের মনপসন্দদের উঠিয়ে নিতে পদোন্নতিবঞ্চিত রাখা হয় তাকে। একই পদে ২০-২২ বছর পড়ে থেকে থেকে অবসরে যান আমার বছরখানেক আগে। অকস্মাৎ গেলেন মরে, পুলিশ হেফাজতে। আমি কবে যাব (মরে), কার হেফাজতে, সে-দুর্ভাবনা চেপে ধরে।
‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাত’, দরদিয়া বাত এদেশে। অপঘাতে মরে গেলে এদেশে মানুষ হয়ে যায় ‘আল্লাহর মাল’, ‘আল্লাহই নিয়েছে’ বলে সান্ত্বনা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে, আগের এক আমলে। বান্দার হাত নেই, মন্ত্রীরও হাত নেই (তিনি তো আবার নাছোড়বান্দা বটে) খোদার ওপর খোদকারি করতে! হায় খোদা! মানুষের দু-দুটো হাত দিলে শুধু দু-হাত তুলে মোনাজাতের জন্য! তাই দিয়ে মানুষ যে রাষ্ট্র, সরকার, বিচার, আইন, আদালত সাজিয়েছে, সেসব তবে শুধু বুলি কপচাতে!
আমার সেই প্রাক্তন সহকর্মীর মৃত্যুর সূত্রপাতটা ঘটেছে আইন-আদালতের হাত ধরে! পুলিশের হাত থাকলেও (ধরে নিয়ে আসতে হয়েছে তো হাত দিয়ে) দোষ নেই মোটে! বিনা ওয়ারেন্টে (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা) নয়, গেছে তারা আদালতের দেওয়া ওয়ারেন্টের চোটে। আদালতেরও তবে একটু হাত ছিল তাতে (ওয়ারেন্ট, আদেশে স্বাক্ষর দিতে হয়েছে তার নিজ হাতে)! তাতে দোষের কী! ওয়ারেন্ট হাঁকাবার ক্ষমতাটা তাকে দিয়েছে আইনে। আইনের তো হাত নেই, চোখ নেই! ‘আন্ধা কানুন’ একেবারে!