রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে বহু সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। ‘শতভাগ বিদ্যুতায়িত উপজেলা’, ‘শতভাগ বিদ্যুতায়িত ইউনিয়ন’ কিংবা ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা’। সাইনবোর্ড পেরিয়ে যদি সেইসব এলাকায় বসবাসের সুযোগ ঘটে তবে নিদারুণ ‘লোডশেডিং’-এর অভিজ্ঞতা হয়, কিংবা দেখা মেলে ‘ভিক্ষুকদেরও’। তার মানে কি দেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন ঘটেনি? ঘটেছে। বিস্ময়করভাবে। এই যে এত কিছু একটার পর একটা অবকাঠামোগত উন্নয়ন এর পেছনে রয়েছে দশাসই বিদ্যুৎশক্তির অবদান। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল কিংবা শত সহস্র কারখানা। বিদ্যুৎ ছাড়া একটিও সম্ভব হতো না। তো এত বিদ্যুৎশক্তি আমরা কীভাবে পাইলাম? উন্নয়নের এক দশাসই চূড়ায় দাঁড়িয়ে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রশ্ন কেবল বাংলাদেশের নয়। এই প্রশ্ন আজ বিশ্বের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমরা কী ব্যবহার করব এবং কীভাবে ব্যবহার করব? কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস কিংবা তেল মানে মাটির তলার জীবাশ্ম জ্বালানিই কি বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবে? পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়েও যথেষ্ট শঙ্কা ও তর্ক আছে। এমনকি তর্ক আছে ভুট্টা নিয়েও। ক্ষুধার্ত দুনিয়া বলছে খাদ্য পুড়িয়ে বায়ো-ডিজেল চাই না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয় বলেই বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। আর এ কারণেই গ্রাম থেকে নগর আবহাওয়ার উল্টাপাল্টা খেলা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন ‘জলবায়ু পরিবর্তন’।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তে থাকলে খুব কম উদ্ভিদ ও প্রাণী পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে, এমনকি নির্দয়ভাবে মৃত্যু ঘটবে মানুষেরও। বিশ্বনেতারা এই উষ্ণতা থামাতে এ পর্যন্ত ২৭ বার বিশ্ব সম্মেলন করেছেন। একের পর এক অঙ্গীকার করছেন। বেহায়ার মতো অঙ্গীকারগুলো ভঙ্গও করছেন। পৃথিবীর কাঁপুনি কিন্তু বাড়ছেই। এমন পরিস্থিতিতে আমরা নিশ্চয়ই বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকতে পারি না। বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সবুজ ভাবনাই সমাধান। তো এই সবুজ ভাবনাটা কী? বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা। মাটির তলার তেল, গ্যাস, কয়লা দিয়ে আমরা আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করব না। এমনতর অঙ্গীকার ও চর্চা আমাদের সবুজ-শক্তির ভবিষ্যৎ দেখায়। বাংলাদেশ কি এই সবুজ-শক্তির পথে হাঁটছে? রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের সেই বার্তা দেয় না। বিজ্ঞানী-গবেষকরা বহু প্রমাণ হাজির করছেন যে, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই সভ্যতার মেরুদ- অচিরেই ভেঙে পড়বে। কিন্তু এই অশনি সংকেত সামাল দিতে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারসমূহ কতখানি সবুজ-শক্তির সপক্ষে? জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে কয়লা, তেল, গ্যাস কিংবা সবুজ-জ্বালানি নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকবে কী? যদি না থাকে তাহলে জ্বালানিশক্তি বিষয়ে রাজনৈতিক অমনোযোগিতা আমাদের বিপন্ন খাদের কিনারে ঠেলে দেবে। আমাদের সব উন্নয়ন তখন কাপ্তাই বাঁধ, সবুজ-বিপ্লব কিংবা হাওরে সড়ক করার মতো দগদগে যন্ত্রণা হয়ে বিদ্রুপ করবে।
কেবল সবুজ-শক্তি নির্ভরতাই কি আমাদের গ্রহকে সুরক্ষা করতে পারে? সর্বোপরি পারে না। কারণ কেবল উৎপাদনকে সবুজ হলেই হবে না, লাগাম টানতে হবে আমাদের সর্ববিনাশী ভোগবিলাসিতার। জীবনযাত্রা ও যাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। গ্রামীণ গরিব নিম্নবর্গের মানুষের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিশক্তির অপচয় করার কোনো পরিস্থিতি নেই। বিদ্যুতের অপচয় বেশি করে শহরের ধনী মানুষেরা। বিদ্যুৎ অপচয়কারীদের আইন ও বিচার কাঠামোয় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। জীবাশ্ম-জ্বালানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই রুগ্ণ পৃথিবীকে বাঁচাতে জলবায়ু সম্মেলনের ২৮তম আসরটি বসতে যাচ্ছে দুবাইতে। কোনো নতুন সিদ্ধান্ত কি নেবেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ? আগের নেওয়া অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে তারা কি সক্রিয় হবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। অথচ নিদারুণভাবে এসব উত্তর প্রায় মীমাংসিত। জ্বালানিশক্তি নিয়ে মীমাংসিত এসব উত্তর কারা কোন ক্ষমতায় ‘অমীমাংসিত’ করে রাখছেন? এসব আলাপ জোরেশোরে পাবলিক পরিসরে হওয়া জরুরি। দুনিয়ার জ্বালানি ও শক্তি খাত দখল এবং নিয়ন্ত্রণ করে রাখা বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্বের সামনে দাঁড়ানো জরুরি। জীবাশ্মবৈচিত্র্যকে ‘জ্বালানি’ হিসেবে বৈধ করে রাখার নয়াউদারবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করা জরুরি।