দেশ রূপান্তর : ১ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক হিসেবে আপনার ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে শুরু করতে চাই। পেছন ফিরে তাকালে আপনার এই সম্পাদক জীবনের মূল্যায়ন করবেন কীভাবে?
মাহফুজ আনাম : ধন্যবাদ। সম্পাদক হলেন ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ। একটা টিমের, একটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান। কিন্তু সেটি কীসের প্রতিষ্ঠান? ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, নাকি সরকারি কোনো সংস্থার প্রধান... তিনি ঠিক কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রধান? সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠান মানে কি? মানে হচ্ছে- সততা, নিরপেক্ষতা এবং সাংবাদিকের যে মূল্যবোধ এসব দিয়ে সে সমাজকে সেবা করবে। এখন সবাই তো সমাজের সেবা করে। সাংবাদিকতার এই সমাজসেবাটা কীভাবে ভিন্ন? প্রথমত, আপনি সমাজসেবা করছেন সত্য কথা বলার জন্য। যারা অন্যায় করছে, তাদের উন্মোচন করা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব না। সংবাদপত্রের দায়িত্ব হচ্ছে বাকস্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং যেসব কাজ সমাজকে কলুষিত করছে তার উন্মোচন করা। তো এই ধরনের একটা প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক হচ্ছে চিফ। আমি মনে করি একজন সম্পাদককে সাংঘাতিক রকম সৎ হতে হয়। আমি যখন সরকারকে একটা রূঢ় কথা বলব, একজন শিল্পপতিকে এক্সপোজ করব, একজন ব্যুরোক্রেটকে তার ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে বলব এখন আমিও যদি সেসব করে থাকি, আমার জীবনেও যদি ওই দুর্বলতাগুলো থাকে, তাহলে কোনো না কোনো সময়ে আমি ধরা পড়ে যাব। কাজেই বলিষ্ঠতার একটা পূর্ব শর্ত হচ্ছে নিজেকে সৎ হতে হবে। এই সততার একটা বিরাট দিক রয়েছে। সেটা হলো আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন, ডেইলি স্টারের যারা রিপোর্টার, সাব-এডিটর, ফিচার রাইটার আছেন, তারা যদি মনে মনে ভাবেন যে সম্পাদক সাহেব তো তার সম্পাদনা ব্যবহার করে নিজের ব্যবসা গোছাচ্ছে বা নিজের আত্মীয় স্বজনকে প্রমোট করছে...। কাজেই, একটা হলো বাইরে একটা দৃঢ়তা সুপ্রতিষ্ঠিত করা আর সংগঠনের ভেতরে আপনার অবস্থান এই দুটোকে রক্ষা করতে হলে একজন সম্পাদককে সাংঘাতিকভাবে সৎ হতে হবে। নিষ্ঠাবান হতে হবে। এবং সব কাজের মধ্যে সমাজকে, মানুষের অধিকারকে সামনে রাখতে হবে। এখন শুনলে মনে হতে পারে যে আমি কাল্পনিক বা ইউটোপীয় কথা বলছি। কিন্তু প্রথমেই ইউটোপিয়া বলে যদি আপনি এটা ত্যাগ করে বলেন যে এটা সম্ভব না, তাহলে কি সম্ভব? এটা তো এমন একটা সমাজ, যেখানে অনেক কিছু আপনি মেনে নিচ্ছেন। ওই মেনে নেওয়ার মাপকাঠিটা কী? একটা মিথ্যা মানবেন না ৯টা, নাকি পাঁচটা মিথ্যা মানবেন আর পাঁচটা মানবেন না...! ধরেন, মূল্যবোধের যখন আপস শুরু হয়, তখন কিন্তু তা আর শেষ হয় না। যদিও ইউটোপিয়া বলে মনে হয় কিন্তু আমার জীবন এই স্বপ্নকে ধরেই অতিবাহিত করছি।
দেশ রূপান্তর : স্বপ্ন বলেন বা ইউটোপিয়া যার কথা আপনি বললেন, আমরা কোল্ড ওয়ারের সময়টা দেখিনি। কিন্তু ইরাক, আফগানিস্তানের পর এখন যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল পরিস্থিতি চলছে সেখানে পশ্চিমা মিডিয়ার যে ভূমিকা, সেখানে আপনার সেই সত্য কোথায়?
মাহফুজ আনাম : ছোটবেলা থেকে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রতি আমার একধরনের দুর্বলতা ছিল। কিন্তু আমি যখন বড় হচ্ছি তখন তো কোল্ড ওয়ার চলছে। একটা ওয়েস্টার্ন মিডিয়া আরেকটা কমিউনিস্ট মিডিয়া। তো কমিউনিস্ট মিডিয়ার প্রতি কোনোভাবেই শ্রদ্ধাশীল হতে পারিনি। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া তার অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েও মনে হয়েছে যে তারা একটা চেষ্টা করে। কিন্তু বিশেষ করে ইরাকের যুদ্ধের পর এবং বর্তমানে ফিলিস্তিনে যেটা চলছে... মানে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই মর্মাহত। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া এখানে তার যে স্বার্থপরতা দেখাল এটার যে একটা অবিশ্বাস্য আকারের ক্ষতি হলো, সেটা ওরা কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না। পশ্চিমা মিডিয়া এবং দেশগুলোরও যে একটা মরাল অথরিটি ছিল সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : ডেইলি স্টারের শুরুর দিনগুলো এবং সম্পাদক হিসেবে আপনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপটটা যদি বলতেন।
মাহফুজ আনাম : ডেইলি স্টারের জন্মটা কিন্তু কাকতালীয় নয়। জাতিসংঘের সংস্থায় আমি প্যারিসে ৫ বছর কাজ করেছি। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৪ বছর কাজ করেছি। এবং সর্বশেষ ব্যাংককে একটা রিজিওনাল রেসপন্স নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু এই পুরোটা সময় কিন্তু আমি সাংবাদিকতার সঙ্গেই যুক্ত ছিলাম। আমি একটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের ছেলে যে অত ব্রিলিয়ান্ট না। আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট না, স্কলারশিপ পাইনি। কিন্তু আমি যে এক্সপোজারটা পেলাম, যখন আমি প্যারিসে ছিলাম ইউরোপিয়ান মিডিয়ায় আমি বেশ এক্সপোজার পেয়েছি। আমেরিকা-কানাডাতেও। তারপর যখন ব্যাংককে থাকলাম ৫ বছর, আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল এশিয়া-প্যাসিফিক জড়িত। তারপর আমি অনেক ট্রাভেল করতাম। আমার এতগুলো দেশের, এতগুলো কাগজ, এতগুলো সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হলো যে আমি মনে মনে ভাবতাম এই অভিজ্ঞতা তো একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কাজেই, আমি চিন্তা করতাম দেশে গিয়ে আমি এটার প্রতিফলন দেখাব। তখন আমার বয়স ৪১ বছর। তখন আমি ছিলাম জাতিসংঘের ইউনেস্কোতে। যার সদর দপ্তর হলো প্যারিসে। তো আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে ইউনেস্কোর কাজে ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় এসে একটা আদর্শিক কাগজ স্থাপন করব। সৌভাগ্যক্রমে ওই সময় ইউনেস্কোতে এস এম আলী বলে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিক হিসেবে বিশেষ করে সাউথ-ইস্ট এশিয়া বিষয়ে বিশ্বজোড়া তার খ্যাতি ছিল। তো উনি তখন ইউনেস্কোর কাজ থেকে অবসরে যাচ্ছিলেন। আর আমি রিজাইন করি। দুজনেই ফিরে এসে ডেইলি স্টার স্থাপন করলাম। ওনার নেতৃত্বে। উনি সম্পাদক, আমি নির্বাহী সম্পাদক। এটা ১৯৯১ সালে, এরশাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হলো আর ডেইলি স্টার বের হলো ১৪ জানুয়ারি ১৯৯১। সেখানে প্রথম যে আর্টিকেল আমি লিখলাম নিজের নামে, প্রথম সংখ্যায়, তার শিরোনাম ছিল ‘ড্রিমস রিবর্ন’। এরশাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাঠামোর যে প্রক্রিয়া, আমি মনে করলাম সেখানে এই ১৬ বছর মিলিটারি এবং কোয়াসি মিলিটারি রিজিমের পরে যে গণতান্ত্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটাই ড্রিমস রিবর্ন। আমার দৃষ্টিতে ৭১-এর যে স্বপ্ন, যেটা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত হলো সেটার আবার রিবার্থ হলো ১৯৯০-তে এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে। এবং ওই সময় দ্য ডেইলি স্টারের জন্ম। কাজেই, বলতে পারেন সমস্ত দিক থেকেই গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা, মানুষের একটা সুষম সমাজ, একটা সরকার যা জনগণের ইচ্ছায় নির্বাচিত হবে... এখন দাঁড়িয়ে বলা যেতে পারে যে কল্পলোকের রূপকথার মধ্যে ডেইলি স্টারের জন্ম।